প্রায় ছয় বছর পর আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা।
এর পরিপ্রেক্ষিতে একজোট হয়ে জলদস্যু-বিরোধী অভিযান চালিয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষ। ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায় জলদস্যুদের আক্রমণ।
কিন্তু গত কয়েক মাসে অন্তত ১৪টি জাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনায় ‘হর্ন অফ আফ্রিকা’ অঞ্চলের সমুদ্র-নিরাপত্তা নিয়ে আবারও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে, কেন কোনভাবেই সোমালিয়ার জলদস্যুদের থামানো যাচ্ছে না?
‘হর্ন অফ আফ্রিকা’
পূর্ব আফ্রিকার একটি অংশের নাম ‘হর্ন অফ আফ্রিকা’। ত্রিকোণাকৃতির ভৌগোলিক মানচিত্রের কারণেই অঞ্চলটিকে এই নামে ডাকা হয়। একে ‘সোমালি উপদ্বীপ’ও বলা হয়।
সমুদ্রপথে বৈশ্বিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা এটি। আর ‘হর্ন অফ আফ্রিকা’র বড় একটি অংশজুড়েই আছে সোমালিয়া।
দীর্ঘ সময় ধরে চলা দেশটির যুদ্ধবিগ্রহ এবং অর্থনৈতিক দুর্দশা ও সমুদ্র উপকূল রক্ষায় প্রশাসনের শক্তিশালী উপস্থিতি না থাকায় অঞ্চলটিতে নাশকতা বাড়তে থাকে।
বিশেষ করে দীর্ঘ সময় ধরে জলসীমার নিরাপত্তায় সরকারি বাহিনীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সেখানে বাড়ে বিদেশি মাছ ধরা নৌযানের উপস্থিতি। ফলে ক্ষতির মুখে পড়ে স্থানীয় জেলেরা।
ফলে সোমালিয়ার সমুদ্র এলাকায় বিদেশিদের এই শোষণ বন্ধে স্থানীয় জেলেরা সশস্ত্র দলে বিভক্ত হয়ে ওই অঞ্চলে বিদেশি জাহাজের প্রবেশ বন্ধের চেষ্টা করে। কিন্তু বিদেশি জাহাজ জিম্মি করে পাওয়া মুক্তিপণের অর্থ পেয়ে দস্যুবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে অনেক সোমালিয়ান তরুণ।
বেড়েছে আক্রমণের ঘটনা
সোমালিয়া থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত এডেন উপসাগরের পথ ধরে বছরে প্রায় ২০ হাজার বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করে। সুয়েজ খালের এই পথটি এশিয়া থেকে ইউরোপ এবং আমেরিকায় যাওয়ার সবচেয়ে দ্রুততম পথ।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই জাহাজ মালিকরা পণ্য পরিবহনে এই পথটিকেই বেছে নেয়। কিন্তু তাতে সমস্যা বাঁধায় সোমালি জলদস্যুরা।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউটের (আরইউএসআই) তথ্যমতে, গত ছয় বছরের যেকোনো সময়ের তুলনায় শেষ তিন মাসে ‘হর্ন অফ আফ্রিকা’য় জাহাজ ও নাবিক জিম্মি করে উচ্চ মুক্তিপণ চাওয়ার ঘটনা বেড়েছে।
একদিকে সোমালিয়ার দারিদ্র্য, অরাজকতা, আইনের শাসনের অভাব, অন্যদিকে গৃহযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতার কারণে দেশটির অনেক তরুণই জলদস্যুতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আর এর সঙ্গে সোমালিয়ার স্থানীয় অভিজাতদের জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও পূর্ব আফ্রিকান জলসীমার দেশগুলো নিয়ে গঠিত আঞ্চলিক সংস্থা ইণ্ডিয়ান ওশান কমিশনের (আইওসি) মতে, সোমালিয়ায় মাছ ধরার নতুন নীতির কারণে বিদেশী মাছ ধরার জাহাজের প্রবেশ বেড়েছে।
আর এর ফলে উপকূলীয় সোমালিরা আবারও জলদস্যুতার দিকে ঝুঁকে পড়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছে আইওসি।
রয়্যাল ডেনিশ ডিফেন্স কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ট্রোয়েলস বুরচাল হেনিংসেন বিবিসিকে বলেন, নিরাপত্তা ঘাটতির কারণে সোমালিয়া উপকূলে জাহাজ হামলা ছিনতাইকারীদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, জলদস্যুতা বেড়ে যাওয়ায় ২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাহিনী এই জলসীমায় টহল দেয়া শুরু করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুথিদের আক্রমণের কারণে লোহিত সাগরকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
যেসব কারণে অপ্রতিরোধ্য সোমালি জলদস্যুরা
সাধারণত ছোট স্পিডবোটে করে এসে দড়ি আর মই দিয়ে জাহাজে উঠে জাহাজের নাবিকদের জিম্মি করে ফেলে সোমালি জলদস্যুরা।
আর কোন উপকূলরক্ষী বা পুলিশের শক্তিশালী উপস্থিতি না থাকায় প্রায় বিনা বাঁধায় সশস্ত্র এই জলদস্যুরা জিম্মি করা জাহাজ সোমালিয়া উপকূলে নোঙর করতে পারে।
২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম এনবিসি নিউজকে এক সাক্ষাৎকার দেন গিলস মেরিট। সেসময় তিনি ব্রাসেলসভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক সিকিউরিটি এন্ড ডিফেন্স এজেন্ডার পরিচালক ছিলেন।
গিলস বলেন, এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগে যে আমরা এমন এয়ারক্রাফট চালাতে পারি যা চলমান যেকোনো কিছু চিহ্নিত করতে পারে। কিন্তু স্পষ্টতই আমরা ছোট নৌকার মধ্যে মেশিনগান হাতে কিছু তরুণকে দেখতে পাই না।
ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী বলছে, তাদের রাডারে জলদস্যুদের টহল ধরা পড়ে এবং তারা জাহাজের ক্রুদের সতর্কও করে।
কিন্তু ভারত সাগর থেকে এডেন উপদ্বীপ অঞ্চলটি বিশাল। ফলে যুদ্ধজাহাজ প্রত্যেক নৌযানকে সুরক্ষা দিতে পারে না, আবার সবসময় ঘটনার পর সেখানে সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিতও হওয়া সম্ভব হয় না।
আবার জলদস্যুদের কোন স্পিডবোট দেখা কিংবা এর অবস্থান শনাক্ত করাই যথেষ্ট না।
সামরিক কর্মকর্তাদের মতে, সমুদ্রের আড়াই মিলিয়ন বর্গমাইল এলাকা ছিনতাইপ্রবণ, যা পুরোপুরিভাবে টহল দেওয়া কার্যত অসম্ভব।
এছাড়াও জলদস্যুরা বড় আকারের ‘মাদার শিপ’ ব্যবহার করে। এটি ব্যবহার করেই তারা সমুদ্রের মাঝখানে ছোট নৌযান থেকে আক্রমণ চালায়।
সমস্যা হলো এই বড় জাহাজগুলোও মূলত ছিনতাই করা। ফলে এগুলো দেখতে অন্য যেকোনো মাছ ধরার নৌকার মতো। যার কারণে সমুদ্রে চলাচল করা এমন হাজার হাজার নৌকার মধ্যে থেকে দুর্বৃত্তদের জাহাজ খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব।
এছাড়া জাহাজের নিয়ন্ত্রণ জলদস্যুদের হাতে চলে গেলে যেকোনো পদক্ষেপ নেয়াও কঠিন হয়ে যায়। কেননা জিম্মি নাবিকদের প্রাণ তাতে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
আর এই জলদস্যুরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাদের সঙ্গে থাকে ভারি অস্ত্র আর গ্রেনেড।
জলদস্যুতা এবং সশস্ত্র ডাকাতি নিয়ে আইসিসি ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) বার্ষিক এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালে ১২০টি জলদস্যুতা এবং সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১১৫।