যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নির্বাচনে মার্কিন নাগরিক নন, এমন কারও ভোট দেওয়া অবৈধ। নানা ঘটনা থেকে করা গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মার্কিন নির্বাচনে এমন ভোট দেওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। ১৯৯৬ সালে প্রণীত ইলিগ্যাল ইমিগ্রেশন রিফর্ম অ্যান্ড ইমিগ্রেশন রেসপনসিবিলিটি অ্যাক্ট অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন, এমন কেউ ফেডারেল নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন না। অবৈধ অভিবাসীরাও এ আইনে অন্তর্ভুক্ত। আইন অমান্য করে কেউ ভোট দিলে শাস্তি হিসেবে এক বছরের কারাদণ্ড, অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এমনকি জড়িত ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারও করা হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে ভোটার হতে হলে একটি অভিন্ন ফরম পূরণ করতে হয়। এ ফরম পূরণের শুরুতেই বলা হয়েছে, ফরম পূরণ করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হতে হবে। কেউ ভুয়া তথ্য দিলে আইন অনুযায়ী তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে ওই ফরম পূরণের সময় কোনো নথিপত্র জমা দিতে হয় না।
তবে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর মিত্ররা দাবি করে আসছেন, নির্বাচনে অবৈধ অভিবাসীদের ভোটের সুযোগ করে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কমলা হ্যারিসের সঙ্গে বিতর্কে ডেমোক্র্যাটদের দিকে ইঙ্গিত করে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা খারাপ। প্রচুর পরিমাণে অবৈধ অভিবাসী আসছেন এবং তাঁদের দিয়ে ভোট দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা।’
যুক্তরাষ্ট্রের উদার নীতি–সংক্রান্ত চিন্তন প্রতিষ্ঠান ব্রেনন সেন্টার ফর জাস্টিসের নির্বাচন–বিশেষজ্ঞ জাসলিন সিং বলেন, ‘ফরম পূরণের শুরুতেই একটি শর্ত দেওয়া আছে, যাতে আপনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক কি না, সেখানে বক্সে টিকচিহ্ন দিতে হয়। অবৈধ অভিবাসীদের এই ফরম পূরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা এটি। সুতরাং কেউ মিথ্যা তথ্য দিয়ে ফরম পূরণ করলে তাঁর জন্য বিরাট ঝুঁকি থেকে যায়।’
সান ফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটির ভোটাধিকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রোনাল্ড হেডিউক বলছেন, নির্বাচনী কেন্দ্রে যোগ্য ভোটারদের তালিকা থাকে। সুতরাং মার্কিন নাগরিক নন, এমন কোনো ব্যক্তি ভোট দিতে গেলে তাঁকে বের করে দেওয়া হবে অথবা প্রভিশনাল ব্যালটে ভোট দিতে বলা হবে। নাগরিক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারলেই কেবল ওই ব্যক্তির ভোট গণনা করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন, এমন ব্যক্তিদের রাজ্যের কোনো নির্বাচনেও ভোট দেওয়া সম্ভব নয়।
অবশ্য ক্যালিফোর্নিয়া, মেরিল্যান্ড, ভারমন্ট ও ওয়াশিংটন ডিসির মতো কিছু রাজ্য, বিশেষ এলাকায় স্কুল বোর্ডসহ নির্দিষ্ট কিছু স্থানীয় নির্বাচনে অবৈধ অভিবাসীদের ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
কিছু গবেষণায় দেখা যায়, মার্কিন ফেডারেল নির্বাচনে অবৈধ অভিবাসীদের ভোট দেওয়ার ঘটনা খুবই বিরল।
২০১৬ সালের নির্বাচনে ১২ অঙ্গরাজ্যে দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন ৪৪ জন নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে ব্রেনন সেন্টার ফর জাস্টিস।
চিন্তন প্রতিষ্ঠানটি দেখেছে, এসব রাজ্যে ২ কোটি ৩৫ লাখ ভোট পড়েছে। এর মধ্যে মার্কিন নাগরিক নন, এমন ৩০ জন ভোট দিয়েছেন বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। ওই সব ভোটের বিষয়ে আরও তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছিল। এসব রাজ্যে যত ভোট পড়েছে, এই হার তার মাত্র ০.০০০১ শতাংশ।
রিপাবিলকানরা ভোটার নিবন্ধন আরও কঠোর করতে ব্যক্তির নাগরিকত্ব প্রমাণকে বাধ্যতামূলক করতে ‘দ্য সেফগার্ড আমেরিকান ভোটার এলিজিভিলিটি (এসএভিই) অ্যাক্ট’ নামের একটি আইন প্রণয়নের প্রস্তাব তুলেছিল। তবে প্রতিনিধি পরিষদে তাদের সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়।
এরপরও রিপাবলিকান আইন প্রণেতারা নাগরিকত্ব শর্তকে যুক্ত করতে নানাভাবে চাপ দিতে থাকে।
প্রতিনিধি পরিষদে শীর্ষ রিপাবলিকান নেতা মাইক জনসন বলেন, ‘আমাদের কিছু অঙ্গরাজ্য রয়েছে, যেখানে ভোটার তালিকা নিয়ে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এতে অনেক ভোটার পাওয়া গেছে, যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন।’
মাইক জনসন ওহাইও, পেনসিলভানিয়া ও জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের কথা বিশেষভাবে বলেন। এই তিন রাজ্যের নানা জরিপ বলছে, দুই প্রার্থী ট্রাম্প ও কমলার মধ্যে এসব রাজ্যে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে।
রিপাবলিকান কর্মকর্তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ওহাইও অঙ্গরাজ্যে একটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, নিবন্ধিত প্রায় ৮০ লাখ ভোটারের মধ্যে মাত্র ৫৯৭টি সন্দেহজনক ঘটনা পাওয়া গেছে। নাগরিক নয়, এমন সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের এসব বিষয় আরও পর্যালোচনার জন্য রাখা হয়েছে।
পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যে ভুলে ড্রাইভারস লাইসেন্স সেন্টারের ইলেকট্রনিক টাচস্ক্রিনে অ-নাগরিকদের ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার সুযোগ আছে বলে প্রদর্শিত হয়েছিল। চালকেরা নতুন লাইসেন্স নিলে বা লাইসেন্স হালনাগাদ করলে এ সুযোগ পাবেন।
লাইসেন্স সেন্টারের সেই ভুল ২০০৬ ও ২০১৭ সালের মধ্যে দেখা গিয়েছিল। পরে ওই সমস্যার সমাধান করা হয়েছে।
১ সেপ্টেম্বর থেকে রিপাবিলকান প্রার্থীরা বা রিপাবলিকান পার্টির বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে যেসব বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে, তার মধ্যে ১১৮টি চিহ্নিত করেছে বিবিসি। এসব বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়েছে, অ-নাগরিকদের ব্যাপকভাবে ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করা হচ্ছে। অথবা এসব বিজ্ঞাপনে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, অ-নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া কি উচিত?
এসব বিজ্ঞাপন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ৭৮ লাখ থেকে ৯০ লাখ বার দেখা হয়েছে। একটি বিজ্ঞাপন ২৪ লাখ বার দেখা হয়েছে। এই বিজ্ঞাপনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের একটি জরিপে অংশ নিতে বলা হয়েছে, যার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে—‘অবৈধ অভিবাসীদের কি ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত?’
কংগ্রেসের নারী সদস্য অ্যান ওয়াগনার আরেকটি বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, যা ৯ লাখের বেশি বার দেখা হয়েছে। এতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের প্রতি একই ধরনের জরিপে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি।