১৯৬৯ সালের ২৯ আগস্ট, ইতালির রোম বিমানবন্দরে সাদা স্যুট, সানহ্যাট এবং চওড়া সানগ্লাস পরা ২৫ বছর বয়সী এক তরুণী অপেক্ষা করছিলেন ফ্লাইট টিডব্লিউএ-৮৪০ এর জন্য। তিনি ভেতরে ভেতরে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। হলিউড অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের মতো দেখতে এই তরুণী বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার চোখে ধুলো দিয়ে নিজের সঙ্গে একটি পিস্তল এবং দুটি হ্যান্ড গ্রেনেড আনতে সফল হয়েছিলেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি এমন ভান করেছিলেন, বিমানবন্দরের ওয়েটিং লাউঞ্জে (যেখানে যাত্রীরা বিমানের জন্য অপেক্ষা করেন) বসে থাকা আরেক ব্যক্তি সেলিম ইসাভিকে তিনি চেনেন না।
সেলিম ইসাভি ছিলেন ফিলিস্তিনের মুক্তিবাহিনী ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইন’(পিএফএলপি) এর চে গেভারা কমান্ডো ইউনিটের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
আর যে তরুণীর কথা বলা হচ্ছে তার নাম লায়লা খালেদ। লায়লা খালেদ একাই বিমানে চড়ে বৈরুত থেকে রোমে এসেছিলেন। লায়লা এবং তার সঙ্গী ইসাভি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রথম শ্রেণীর আসন বুক করেছিলেন যাতে তারা সহজেই বিমানের ককপিটে প্রবেশ করতে পারে।
লায়লা খালিদ ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত তার আত্মজীবনী মাই পিপল শ্যাল লিভ-এ লিখেছেন, ‘যেহেতু ইসাভি এবং আমি ওয়েটিং লাউঞ্জে আলাদা সিটে বসেছিলাম, সেই সময় শিকাগো থেকে আসা একজন গ্রিক-আমেরিকান আমার সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করেন।’
‘তিনি আমাকে বলেছিলেন যে ১৫ বছর আমেরিকায় থাকার পর তিনি তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গ্রিসে যাচ্ছেন। এক সময় মনে হয়েছিল তাকে এই বিমান ছেড়ে অন্য বিমানে যেতে বলি, কিন্তু তারপর আমি নিজেকে দমিয়ে রাখি।’
বিমানের ভেতরে লায়লা খালেদ ও সেলিম ইসাভির আসন কাছাকাছি ছিল। বিমানবালা লায়লাকে কফি এবং ইসাভিকে বিয়ার পরিবেশন করেন। এরপর বিমানবালা লায়লাকে কিছু খাওয়ার জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করলেও তিনি কিছু খাননি। বরং তিনি বিমানবালাকে বলেন যে তার খুব ঠাণ্ডা লাগছে এবং পেটে ব্যথা করছে, তাই তারা যেন তাকে একটি অতিরিক্ত কম্বল দিয়ে যায়।
কম্বল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লায়লা তার হ্যান্ড গ্রেনেড এবং পিস্তল কম্বলের নিচে রেখে দেন যাতে প্রয়োজনে সেগুলো সহজে হাতের কাছে পাওয়া যায়। শুট দ্য উইমেন ফার্স্ট-এর লেখিকা আইলিন ম্যাকডোনাল্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লায়লা খালেদ বলেছিলেন, ফ্লাইট ক্রুরা খাবার পরিবেশন করা শুরু করতেই সেলিম লাফিয়ে উঠে ককপিটে পৌঁছে যান। আমিও আমার কোলে থাকা হ্যান্ড গ্রেনেড হাতে নিয়ে তার পিছনে দৌড়ে যাই।
এগুলো দেখে বিমানবালার হাত থেকে ট্রে পড়ে যায় এবং তিনি জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকেন। এসময় আমার কোমরে আটকে থাকা পিস্তলটা আমার প্যান্টের ভিতর দিয়ে গলে বিমানের মেঝেতে পড়ে যায়। এরপর আমি এবং ইসাভি চিৎকার করে বলি, প্রথম শ্রেণির সব যাত্রী এবং ক্রুদের বিমানের পেছনে ইকোনমি ক্লাসে যেতে হবে।
এই ছিনতাইয়ে লায়লা খালেদকে পাইলট ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। শুরুতে লায়লা পাইলটকে ওই বিমানটি ইসরায়েলের লোদ বিমানবন্দরে নিয়ে যেতে বলেন। এটি তখন ডেভিড বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর নামে পরিচিত।
বিমানটি ইসরায়েলের ভূখণ্ডে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই এর দুপাশে তিনটি ইসরায়েলি মিরাজ বিমান উড়তে শুরু করে। এতে বিমানে বসা যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারা ভেবেছিল ইসরায়েলি বিমান তাদের বিমানটিকে গুলি করে ভূপাতিত করবে।
লায়লা খালেদ লোদের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং বলেন, এখন আপনারা আমাদের ফ্লাইট টিডব্লিউএ-৮৪০ বলার পরিবর্তে, ফ্লাইট পিএফএলপি ফ্রি আরব প্যালেস্টাইন বলে সম্বোধন করবেন। বিমানের পাইলট প্রথমে লায়লার নির্দেশ মানতে অস্বীকার করেছিলেন কিন্তু লায়লা যখন তাকে তার হ্যান্ড গ্রেনেড দেখান, তখন ওই পাইলট প্রতিবাদ করা বন্ধ করে তার নির্দেশ মানতে শুরু করেন।
লোদ বিমানবন্দরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল শুধুমাত্র ইসরায়েলিদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য। বিমানটি লোদের উপর দিয়ে উড়ে যায়। সেই সময় নিচে শত শত ইসরায়েলি সৈন্য ও ট্যাঙ্ক তাদের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত ছিল।
এরপর লায়লা খালেদ পাইলটকে বিমানটি দামেস্কে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। পথে তিনি পাইলটকে তার জন্মস্থান হাইফার উপর দিয়ে উড়ে যেতে বলেন। লায়লা খালিদ পরে তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, যখন আমি উপর থেকে ফিলিস্তিনের দিকে তাকালাম, এক মিনিটের জন্য আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে আমি একটি অভিযানে আছি।
তিনি বলেন, আমার ইচ্ছা হচ্ছিল দাদী, ফুফু সবাইকে ডেকে বলতে যে আমরা ফিরে আসছি। পরে পাইলটও বলেছিলেন যে, আমরা যখন হাইফার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম, তখন তিনি দেখেছেন আমার মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। মুখে সব লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছে।
দামেস্ক বিমানবন্দরে অবতরণের পর সেলিম ইসাভি বিমানের ককপিটে বিস্ফোরক দ্রব্য পুঁতে রেখে তা উড়িয়ে দেন। তার মতে, এটিই ছিল ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
লায়লা খালেদকে প্রায়ই প্রথম নারী হাইজ্যাকার হিসেবে কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তবে খুব কম মানুষই জানেন, এর তিন বছর আগে ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বরে, কনডর সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি বিমান হাইজ্যাক করে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে যাওয়া হাইজ্যাকারও একজন নারী ছিলেন।
আইলিন ম্যাকডোনাল্ড তার শুট দ্য উইমেন ফার্স্ট বইতে লিখেছেন, পিএফএলপি তাদের নেতৃত্বে এই হাইজ্যাকিং থেকে যে প্রচার পেয়েছিল তাতে তারা খুব খুশি হয়েছিল।
সংগঠনটি তাদের তারকা কমরেড লায়লা খালেদকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় সফরে পাঠায়। তারা জানত যে লায়লা খালেদকে অপহরণ ও হত্যা করার জন্য ইসরায়েলিরা যে কোনো কিছু করতে পারে। কিন্তু তারপরও তাকে আরব দেশ সফরে পাঠানো হয়েছিল। তবে তার চারপাশে দেহরক্ষীদের মোতায়েন করা হয়েছিল।
ওই হাইজ্যাকের ঘটনায় আরব বিশ্বের নায়িকা হয়ে উঠেছিলেন লায়লা খালেদ।
এরপর লায়লা খালেদ তার নাক, গাল, চোখ ও মুখের ছয়টি স্থানে প্লাস্টিক সার্জারি করেন। যাতে তার চেহারা পরিবর্তন করা যায় এবং তাকে আরেকটি ছিনতাইয়ের জন্য প্রস্তুত করা যায়। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে, লায়লা খালেদ লেবানন থেকে ইউরোপে চলে যান। ৪ সেপ্টেম্বর, জার্মানির স্টাটগার্টে, তিনি প্যাট্রিক আর্গুয়েলোর সঙ্গে দেখা করেন, যিনি পরবর্তী হাইজ্যাকিংয়ে তাকে সাহায্য করছিলেন।
তাদের দুজন এর আগে কখনো একসাথে দেখা হয়নি। ৬ সেপ্টেম্বর দুজনেই নিউইয়র্কের টিকিট নিয়ে একসঙ্গে স্টাটগার্ট থেকে আমস্টারডাম যান। প্যাট্রিক আমেরিকায় জন্ম নেয়া নিকারাগুয়ার নাগরিক ছিলেন। আমস্টারডামে, তারা দুজনেই নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে ইসরায়েলি এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭০৭ বিমানের ফ্লাইট ইএলএআই ২১৯-এ চড়ে বসেন।
সারা আরভিং তার বই লায়লা খালেদ: আইকন অফ প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন-এ লিখেছেন, তারা দুজন যখন বিমানে উঠেন, তখন তারা জানতেন না যে তাদের দুই সহকর্মী যাদের এই ছিনতাইয়ে সাহায্য করার কথা ছিল তাদেরকে বিমানে সিট দিতে অস্বীকার করেছিলেন ইসরায়েলি এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তারা।
ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করার সময়, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে ইএলএআই-এর বিমান হাইজ্যাক করার জন্য দুইজনের বেশি মানুষের প্রয়োজন হবে কারণ ওই বিমানে সশস্ত্র নিরাপত্তা রক্ষী ছিল এবং বিমানের আরোহীদের তিনবার তল্লাশি করা হয়।
এবার লায়লা খালেদ ও তার সঙ্গী ইকোনমি ক্লাসে বসেছিলেন। বিবিসির সঙ্গে আলাপকালে লায়লা খালেদ বলেন, প্যাট্রিক জানতেন তাকে কী করতে হবে এবং আমি জানতাম আমাকে কী করতে হবে। আমাদের সঙ্গে অস্ত্র ছিল। আমার কাছে দুটি হ্যান্ড গ্রেনেড এবং প্যাট্রিকের কাছেও একটি হ্যান্ড গ্রেনেড ছিল। আমি খুব ছোট স্কার্ট পরেছিলাম। আমি সেই স্কার্টের ভিতরে বিমানের নকশা লুকিয়ে রেখেছিলাম।
খালিদ ককপিটের দিকে দৌড়ে গেলে পাইলট এরিমধ্যে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। ডেভিড রাব তার বই ‘টেরর ইন ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’-এ লিখেছেন, লায়লা খালেদ তার বিশেষভাবে তৈরি ব্রা থেকে দুটি হ্যান্ড গ্রেনেড বের করেন, কিন্তু তখনই বিমানে থাকা মার্শালরা গুলি চালাতে শুরু করে।
প্যাট্রিক পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করেন। এতে শ্লোমো ওয়েডার নামে এক মার্শালের পায়ে গুলি লাগে। অন্যদিকে প্যাট্রিকও গুলিবিদ্ধ হন। এসময় খালেদের ওপর দুই প্রহরী ও যাত্রীরা হামলা চালায়। লোকজন তাকে মারধর করতে থাকলে তার পাঁজরের কয়েকটি হাড় ভেঙ্গে যায়।
এর মধ্যেই বিমানটির চৌকস পাইলট বিমানটিকে হঠাৎ নীচের দিকে ওড়াতে শুরু করেন। আকস্মিক ওই ডাইভ দেয়ার ফলে লায়লা খালেদ ভারসাম্যহীন হয়ে বিমানের মেঝেতে পড়ে যান। তবে বিমানের ওই হঠাৎ ঝাঁকুনিতে যাত্রীদের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়েনি কারণ তাদের সিট বেল্ট বাঁধা ছিল।
বিমানটি খুব দ্রুত নিচে নেমে আসায় কেবিনের মধ্যে যদি কোন গ্রেনেড বিস্ফোরণ হতো তাতে কেবিন ডিপ্রেশারাইজড (বাতাসের চাপ কমে যাওয়া) হতো না এবং ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও কমে গিয়েছিল। কেননা বিমানটি যতো নিচে নামছিল বিমানের ভেতরে বাতাসের চাপ ততো বাড়তে থাকায় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাও কমে আসছিল।
বিবিসির সঙ্গে আলাপকালে লায়লা খালেদ বলেছেন যে সে সময় তার কী অবস্থা হয়েছিল। তিনি বলেন, আধাঘণ্টা পর আমরা উঠে দাঁড়াই এবং আমি দাঁত দিয়ে হ্যান্ড গ্রেনেডের পিনটা সরানোর চেষ্টা করছিলাম।
তিনি বলেছেন, আমরা উঠে চিৎকার করতেই নিরাপত্তাকর্মীরা পেছন থেকে গুলি চালাতে শুরু করে। দেখলাম ককপিটের ম্যাজিক আই থেকে কেউ আমাদের দেখছে। আমি তাদের হুঁশিয়ার করে বলি যে আমি তিন পর্যন্ত গুনবো। ততক্ষণে ককপিটের দরজা না খুললে বিমান উড়িয়ে দেয়া হবে। কিন্তু আমি আসলে বিমানটি ধ্বংস করতে চাইনি।
এই সতর্কতা দেয়ার পরও তারা ককপিটের দরজা খোলেনি। কিছুক্ষণ পর কেউ একজন আমার মাথার পেছনে আঘাত করলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।
লায়লা খালেদ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, আমি এক মার্শালকে রক্তাক্ত প্যাট্রিকের কোমরের ওপর দাঁড়িয়ে তার পিঠে চারটি গুলি করতে দেখেছি। আহত মার্শাল শ্লোমো ওয়েডারের শারীরিক অবনতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে ইএলএআই-এর পাইলট লন্ডনে জরুরি অবতরণ করে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ইএলএআই-এর আরেকটি বিমান ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। ডেভিড রব তার বই ‘টেরর ইন ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ -এ লিখেছেন, মার্শাল বার লেভাও, যিনি প্যাট্রিককে গুলি করেছিলেন, তাকে বিমানের হ্যাচ বা দরজা দিয়ে নামিয়ে অন্য ওই ইএলএআই বিমানে তুলে দেওয়া হয় যাতে তিনি ব্রিটিশ এখতিয়ার থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। যেন তাকে প্যাট্রিককে হত্যার জন্য দায়ী করা না যায়। এদিকে বিমানের ভেতরে লায়লা খালেদকে যাত্রীদের সিট বেল্ট দিয়ে জোর করে বেঁধে মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছিল।
লায়লা খালেদ ভাগ্যবান ছিলেন যে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী তাকে বন্দি করেনি। তাকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ। বিমানটি অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে প্যাট্রিক আর্গুয়েলোর নিথর দেহ একটি অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
লায়লা খালেদ তার আত্মজীবনী মাই পিপল শ্যাল লিভ-এ লিখেছেন, আমি নিরাপত্তা কর্মীদের অনুরোধ করেছিলাম তারা যেন আমার হাতের বাঁধন খুলে দেয়। আমি প্যাট্রিকের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে তার হাত ধরি। আমি তার আঘাত পরীক্ষা করে বন্ধুত্বের মন থেকে ঠোঁটে চুমু খাই। তারপর ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলি। এটা আমার জন্য খুবই কষ্টকর ছিল কারণ আমার মনে হয়েছে যে তার জায়গায় আমার মরা উচিত ছিল, কারণ এটি ছিল আমাদের লড়াই। প্যাট্রিক শুধু আমাদের সাহায্য করতে এসেছিল।
লায়লা খালেদকে লন্ডনের ইলিং থানায় নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তাকে পরের কয়েকদিন চিফ সুপারিন্টেনডেন্ট ডেভিড প্রিউ জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জেলে লায়লার সঙ্গে ভালো আচরণ করা হয়েছিল। কয়েকজন নারী পুলিশ তার সঙ্গে টেবিল টেনিসও খেলেন।
লায়লা লেখাপড়ার জন্য কিছু উপকরণ চাইছিলেন। যখন তাকে নারীদের কিছু পত্রিকা পড়ার জন্য দেওয়া হয়, তখন তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে সেগুলি নিতে অস্বীকৃতি জানান। তারপর তাকে সংবাদপত্র সরবরাহ করা হয়। লায়লাকে গোসল করার জন্য স্টেশন প্রধানের বাথরুম ব্যবহার করতে দেওয়া হতো। তাদের জন্য পরিষ্কার কাপড় ও তোয়ালের ব্যবস্থা ছিল।
তার ঘরে একজন নারী রক্ষী নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করা হলে লায়লা রেগে গিয়ে জবাব দেন, আমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছি না। আমাকে আরও অনেক অভিযানে অংশ নিতে হবে। লায়লা খালেদ যখন তার ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, তিনি কিছু সময়ের জন্য খোলা বাতাসে শ্বাস নিতে চান, তখন তাকে কারাগারের উপরের তলায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং জানালা খুলে দেওয়া হয় যাতে তিনি তাজা বাতাস উপভোগ করতে পারেন।
তাকে দিনে ছয়টি রথম্যান সিগারেট খাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। অনেক সময় পুলিশ সদস্যরা তাকে ধূমপানের জন্য ছয়টিরও বেশি সিগারেট সরবরাহ করতেন।
লায়লা খালিদকে জিজ্ঞাসাবাদের সময়, ডেভিড প্রিউ তাকে জানান যে ইএলএআই বিমান ছাড়াও, সুইস এয়ার, টিডব্লিউএ, পানাম এবং ব্রিটিশ এয়ারের বিমানগুলোও হাইজ্যাক করা হয়েছিল। এ কথা শুনেই লায়লা খালিদ বলেন, ব্রিটিশ এয়ারের বিমান ছিনতাইয়ের কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিল না।
প্রিউ তাকে জানান, ৯ সেপ্টেম্বর বাহরাইন থেকে লন্ডনগামী ব্রিটিশ এয়ারের একটি বিমান হাইজ্যাক করে জর্ডানের ডসন ফিল্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। লায়লা খালিদ তাকে জিজ্ঞেস করেন যে হাইজ্যাকাররা কী দাবি করেছে। তখন প্রিউ তাকে উত্তর দেন যে তারা লায়লা খালেদের মুক্তি চায়।
২৮ সেপ্টেম্বর পুলিশ প্রহরীরা লায়লাকে কাঁদতে দেখেন। ওই দিন পত্রপত্রিকায় মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদুল নাসেরের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়।
অবশেষে ব্রিটিশ সরকার জিম্মি করা ১১৪ জন যাত্রীর বিনিময়ে লায়লা খালেদকে মুক্তি দেয়। টানা ২৪ দিন ব্রিটিশ কারাগারে থাকার পর, ১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর লায়লা খালেদকে বহনকারী রয়্যাল এয়ার ফোর্সের একটি বিমান কায়রোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
এর আগে ১২ সেপ্টেম্বর, ডসন ফিল্ডে হাইজ্যাক করা সব বিমান বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনার বহু বছর পর বিবিসি লায়লা খালেদকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি যা করেছেন তার জন্য আপনি কি অনুতপ্ত? লায়লা খালেদের উত্তর ছিল, মোটেই না।
তাকে আবার প্রশ্ন করা হয়, আপনার কারণে বিমানে থাকা শত শত যাত্রী আতঙ্কিত হয়ে মানসিক আঘাত পেয়েছেন এবং বিমানের স্টুয়ার্ডও গুরুতর আহত হয়েছেন? জবাবে লায়লা খালিদ বলেন, আমি ক্ষমা চাইতে পারি যে তিনি আহত হয়েছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নিরাপদ ছিলেন।
তিনি বলেছেন, তাদের ক্ষতি করা এই কাজের উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু আপনার এটাও দেখা উচিত যে মানুষ হিসেবে আমাদের মানবাধিকার উপেক্ষা করা হয়েছে। ৭৭ বছর বয়সী লায়লা খালেদ বর্তমানে আম্মানে বসবাস করছেন। তিনি সেখানকার এক চিকিৎসক ফায়াজ রশিদ হিলালকে বিয়ে করেন, যার সঙ্গে তার দুটি সন্তান রয়েছে, যাদেরে নাম বদর এবং বাশার।
এখন তার দিকে তাকালে কেউ বলতে পারবে না যে, এক সময় সাদাকালো চেক কেফিয়াহ পাগড়ি পরা এবং হাতে একে-ফোর্টিসেভেন রাইফেল বহনকারী এই তরুণী ফিলিস্তিনি সংগ্রামের সবচেয়ে বড় পোস্টারগার্ল ছিলেন।