পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন ইমরান খানের দলের প্রতীক ‘ব্যাট’ কেড়ে নিয়েছে। সরকার দলটির নেতাকর্মীদের নির্বাচনি প্রচারেও নামতে দেয়নি সেভাবে। বিপরীতে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে দেশের বাইরে থেকে ডেকে এনে সাজা স্থগিত করে নির্বাচনে ব্যাপক সুবিধা দিয়েছে দেশটির তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিশ্লেষকেরাও মনে করছেন, পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন নওয়াজ শরিফ। তবে এই নির্বাচনে যেই জয়ী হোক না কেন, পাকিস্তানের ক্ষমতার নাটাই সেনাবাহিনীর হাতেই থেকে যাবে।
মুসলিম লীগের নেতা পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি গ্রেফতার করা হয়। দিনটি ছিল মঙ্গলবার। রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাকে কারাবন্দি করে স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের সরকার।
সেই ঘটনার ঠিক ৬২ বছর পর, একই তারিখ ও একই দিনে কারাগারে বিশেষ আদালত বসিয়ে পাকিস্তানের আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে রাষ্ট্রীয় গোপন নথি ফাঁসের মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
দুটি ঘটনার সাযুজ্য নিয়ে ফরাসি লেখক জ্যঁ ব্যাপতিস্ত আলফনসে কা’র একটি উক্তি মনে পড়ে যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘বিষয় যতই পরিবর্তিত হোক, ঘুরে ফিরে আগের মতই থাকে।’ ধরা যাক, আপনি ভাবলেন, নিজেকে অনেক পরিবর্তন করে ফেলেছেন। কিন্তু, দেখা গেল আপনি আগের মত করেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এবং আগের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছেন।
পাকিস্তানেও যেন একই পরিস্থিতি। আপাতদৃষ্টে দেশটি যতই গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করুক, ঘুরে ফিরে স্বৈরশাসন টিকে থাকছে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তোলা হলেও সোহরাওয়ার্দী ও ইমরান খানকে কারাবন্দি করার কারণ ছিল ভিন্ন। তা হলো, স্বৈরশাসনের কবল থেকে পাকিস্তানের মুক্তির পক্ষে কথা বলা। গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলে পরিচিত সোহরাওয়ার্দী সব সময় চেয়েছেন, পাকিস্তান স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পাক।
ইমরান খানও তার ক্ষমতার শেষ দিকে এসে সেনাবাহিনীর বিরাগভাজন হয়েছেন একই কারণে। তবে সেনাবাহিনীর প্রিয়পাত্র হিসেবেই ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান।
সামরিক শাসনের বাইরেও বাকি সময় দেশটির শাসন কাজে সেনাবাহিনী সরাসরি না হোক, পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। কখনো সমর্থিত রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে, কখনো নেতার মাধ্যমে। আবার কখনো কখনো সেনাবাহিনীর প্রিয়রা তাদেরই বিরুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। যেমন- ইমরান খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো। বিনিময়ে ভুট্টোকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ইমরান খানও জেলে বন্দী। তবে নওয়াজ শরিফের মতো অনেকেই আবার সমঝোতা করে ক্ষমতার মসনদে ফিরে এসেছেন বারবার।
চীনের কিংবদন্তি নেতা মাও সে তুং বলেছিলেন, ‘দলই সব সময় বন্দুকের নল নিয়ন্ত্রণ করবে, বন্দুকের নল যেন কখনো দলকে নিয়ন্ত্রণ না করে। ’
কিন্তু পাকিস্তানের বেলায় বিষয়টি উল্টে গেছে। বন্দুকের নলই দলকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। পাকিস্তানের কয়েক দশকের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, বন্দুকই সব সময় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই বন্দুকের ওপর নিজেদের প্রাধান্য কায়েম করতে পারেনি। ইমরান খান পরিস্থিতির চক্রে বন্দুকের নলকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিলেন। ফলাফল হিসেবে তাকে ক্ষমতাচ্যুত তো বটেই, কারাভোগও করতে হয়েছে।
গত বছরের আগস্টে দেওয়া তোশাখানা মামলার রায়ের পর জানুয়ারির শেষ দিকে কয়েক দিনের ব্যবধানে ইমরানের বিরুদ্ধে তিন মামলায় যথাক্রমে ১০, ১৪ ও ৭ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এটি মূলত পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীর গভীর কারসাজি। বিচারব্যবস্থায় সেনাবাহিনী ও দোসরেরা গভীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। অভিযোগের সত্যতা যাই হোক না কেন, ক্যাঙারু আদালত তাড়াহুড়ো করে যে রায় দিয়েছে তা ইমরান খানের নির্বাচনি ভাগ্য সম্পূর্ণ ও অপরিবর্তনীয়ভাবে বন্ধ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা এবং এটি সেনাবাহিনীর ইচ্ছারই প্রতিফলন।
এই রায়ের মাধ্যমে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ইমরান খানকে ‘জাতীয় নিরাপত্তা জন্য ঝুঁকি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। একইসঙ্গে তাকে আর্থিক ও নৈতিকভাবেও দুর্নীতিগ্রস্ত বলে প্রমাণের প্রয়াস পেয়েছে। একগুচ্ছ রায়ের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ও তার দোসরেরা পাকিস্তানের গণপরিষদ নির্বাচনে ইমরান খানের জন্য সামান্যতমও সুযোগও রাখেনি।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইমরান খান যখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে টার্গেট করে বক্তব্য ও রাজনৈতিক কর্মসূচি দিচ্ছিলেন তখন তার প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী নওয়াজ শরিফের দল গোপনে ও নীরবে সেনাবাহিনীর আস্থা অর্জনের চেষ্টা চালাচ্ছিল। দেশে ফিরে নওয়াজ শরিফও সেনাবাহিনীর কোনো সমালোচনাই করেননি। কেবল নওয়াজ নন, পাকিস্তানের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি বা পিপিপিও সেনাবাহিনীকে চটানোর বিরুদ্ধে। সেনাবাহিনীকে ‘নির্বাচনের ফলাফলের নিয়ন্ত্রক’ হিসেবে মেনেই নিয়েছে দলগুলো।
ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ স্যামুয়েল ফাইনার তার বই ‘দ্য ম্যান অন হর্সব্যাক: দ্য রোল অব দ্য মিলিটারি ইন পলিটিকস’ বইয়ে বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে সামরিকবাহিনী সব সময়ই দুটি ভয়াবহ দুর্বলতায় ভোগে। এই দুর্বলতা দুটি তাদের বেসামরিক সহযোগিতা ছাড়া নিজ নামে প্রকাশ্যে শাসন চালানো থেকে বিরত রাখে। তবে এ ক্ষেত্রেও কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।’
স্যামুয়েল ফাইনার বলছেন, ‘সেনাবাহিনীর দুটি দুর্বলতার একটি হলো— প্রশাসন বা রাষ্ট্র পরিচালনায় সশস্ত্রবাহিনীর কারিগরি দক্ষতার অভাব। তাদের যে দক্ষতা তা দিয়ে কেবল একটি আদিম সম্প্রদায়কেই শাসন করা সম্ভব। দ্বিতীয়টি হলো—বৈধতার অভাব। অর্থাৎ, শাসন করার ক্ষেত্রে তাদের কোনো নৈতিক অধিকার নেই।’ পাকিস্তানে মানবাধিকার আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূতও স্যামুয়েল ফাইনারের মতো করেই বুঝতে পেরেছিলেন। তার বোধ ছিল, পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে সেনাবাহিনীর ‘বুদ্ধু জেনারেলরাই’ যথেষ্ট।
গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো-পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেদের দেশপ্রেম, জাতীয় স্বার্থ, পররাষ্ট্র ও জাতীয় নিরাপত্তা নীতির চূড়ান্ত প্রণয়নকারী এবং নির্বাহক বলে মনে করে। একইসঙ্গে ক্ষমতা ও শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি নিজেদের কবজায় নিতে তারাই ইমরান খান ও সর্বশেষ পিডিএম জোটের হাইব্রিড শাসনব্যবস্থাকে ব্যবহার করেছে। অথচ ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান যখন দেশে প্রথম সামরিক শাসন জারি করেন, তখনো এমন পরিস্থিতি দেখা যায়নি।
সরকার ও শাসনব্যবস্থায় সেনাবাহিনী এমনভাবে জেঁকে বসেছে, শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে পিডিএম সরকার সেনাবাহিনীর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাংবিধানিক ও আইনি ভিত্তি দিতে বাধ্য হয়েছে। একই সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে শাহবাজের পিডিএম সরকার। ফলে এখন পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ২০১৮ সালের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
যদিও নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি বা প্রচারণার সময় নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি দেশের বিভিন্ন বিষয় যেমন, সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক, বৈদেশিক নীতি, বেলুচিস্তানে ক্রমবর্ধমান সংঘাত, বেশ কয়েকটি পশতু অঞ্চলে বিপর্যয়কর নিরাপত্তা পরিস্থিতি উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু আগামী দিনে কোনো সরকারই এই বাস্তবতা এড়িয়ে যেতে পারবে না। কোনো সুযোগই নেই।
ক্রমবর্ধমান ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য, বাজেটে সামরিক বরাদ্দ বৃদ্ধির আগ্রাসী ক্ষুধা, অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে সাংবিধানিক অবস্থান ইত্যাদি কারণে পাকিস্তানের অর্থনীতিতেও সেনাবাহিনী আগের চেয়ে অনেক বেশি গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে। এই অবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা দলগুলো দেশটির সংকট নিরসনে কোনো ইশতেহারই ঘোষণা করেনি। যাও করেছে, সেগুলো যতটা না নীতি নির্ধারণী, তার চেয়ে বেশি ‘ইচ্ছাপূরণ’ বলেই বেশি প্রতিভাত হয়। ফলে সরকার যেই আসুক না কেন পাকিস্তানের সরকার পরিচালনার নির্দেশনা আসবে সেনাবাহিনী থেকেই।
পাকিস্তানের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, মুহাম্মদ খান জুনেজো ও মীর জাফরুল্লাহ খান জামালির মতো দুর্বলতম প্রধানমন্ত্রীরাও যথাক্রমে প্রতাপশালী স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হক ও জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সঙ্গে মতভেদ করেছিলেন। সাংবিধানিক কর্তৃত্ব জাহিরের চেষ্টা করায় নওয়াজ শরিফকেও সেনাবাহিনী তিনবার ক্ষমতাচ্যুত করে। সর্বশেষ দেশের গণতন্ত্র থেকে ইমরান খানকে নির্বাসিত করতে গণতন্ত্রকেই ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী।
ইমরান খানের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ রয়েছে। নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে শত্রুতো বটেই, এমনকি বন্ধুদেরও তিনি ছাড় দেননি। কিন্তু তারপরও পাকিস্তান সরকারের উচিত ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
ইমরান খানকে দূরে রাখার জন্য সেনাবাহিনী যেভাবে নির্বাহী বিভাগ, সংসদ, বিচার বিভাগ ও নির্বাচনি যন্ত্র নিয়ে কারসাজি করেছে তা যে কেবল সেসব প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তা নয়, ভবিষ্যতে অস্থিতিশীল ও রাজনৈতিকভাবে বিশৃঙ্খল পাকিস্তান সৃষ্টির মঞ্চও তৈরি করেছে। ইতিমধ্যেই প্রায় অকার্যকর গণতন্ত্র অনেক ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। সব মিলিয়ে নির্বাচনে যারাই জিতুক না কেন, ‘বিপজ্জনক বুদ্ধুরাই’ দেশটিতে রাজত্ব করবে।
তথ্যসূত্র: দ্য ওয়ার।