করোনা মহামারির পরপরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে টাল-মাটাল করে দিয়েছে। ভয়াবহ এ সংকট থেকে বাদ যাচ্ছে বিশ্বের বড় বড় সব প্রতিষ্ঠানগুলোও। এমন পরিস্থিতিতে টেক জায়ান্টগুলোতে চলছে কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রতিযোগিতা।
সম্প্রতি টুইটারের, ফেসবুক, গুগল ও মাইক্রোসফ্টের মতো মার্কিন টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলো তাদের অসংখ্য কর্মী ছাঁটাই করেছে। চাকরিচ্যুত এসব কর্মীদের মধ্যে রয়েছেন হাজার হাজার ভারতীয় নাগরিক।
হঠাৎ করেই চাকরি হারিয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করা ভারতীয়দের ভবিষ্যৎ। এখন তারা ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আরেকটি চাকরির ব্যবস্থা করে কোনোরকমে মার্কিন মুলুকে থেকে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, গত বছরের নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ আইটিকর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে, যার মধ্যে গুগল, মাইক্রোসফ্ট, ফেসবুক ও অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠান রেকর্ড ছাঁটাই চালিয়েছে।
জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি আইটি প্রতিষ্ঠানের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কর্মীই ভারতীয়। আর তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মী এইচ-১বি ও এল১ জব ভিসায় দেশটিতে অবস্থান করছেন।
এইচ-১বি ভিসা হলো একটি নন-ইমিগ্র্যান্ট জব ভিসা। এ ভিসা মাধ্যমে মার্কিন কোম্পানিগুলো তাত্ত্বিক বা প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রয়োজন এমন বিশেষ পেশায় বিদেশি কর্মী নিয়োগের সুযোগ পায়। প্রযুক্তি সংস্থাগুলো এটির মাধ্যমে ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো থেকে প্রতি বছর কয়েক হাজার কর্মী নিয়োগ দিয়ে থাকে।
এল-১এ ও এল- ১বি ভিসাগুলো তাদের দেওয়া হয় যারা পরিচালক পদে কাজ করেন বা কোনো বিষয়ে যাদের বিশেষ জ্ঞান রয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় আইটি পেশাদার এইচ-১বি এর মতো নন-ইমিগ্র্যান্ট ওয়ার্ক ভিসায় রয়েছেন।
আর যারা এল১ ভিসায় রয়েছেন তারা এখন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নতুন চাকরি খোঁজার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এক কথায় যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যাওয়ার সব ধরনের বিকল্প খুঁজছেন ছাঁটাই হওয়া ভারতীয় কর্মীরা।
নাম না প্রকাশের শর্তে অ্যামাজনের এক কর্মী বলেন, মাত্র তিন মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি। কিন্তু এ সপ্তাহেই জানানো হয়েছে, আমার শেষ কর্মদিবস ২০ মার্চ।
এইচ-১বি ভিসায় অবস্থানকারীদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ, কারণ ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে তাদের নতুন চাকরি খুঁজে নিতে হয়। অন্যথায় দেশে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে ৬০ দিন কেন তিন মাসের মধ্যে উপযুক্ত নতুন চাকরি খুঁজে পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব বলে মনে করছেন অনেকে।
এইচ-১বি ভিসায় মাইক্রোসফ্টে কাজ করা আরেক ভারতীয় কর্মী সীতা (ছদ্মনাম) বলেন, ১৮ জানুয়ারি জানিয়ে দেওয়া হয় আমার আর চাকরি নেই। আমি সিঙ্গেল মাদার। ছেলেকে হাই স্কুলে ভর্তি করানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় চাকরি চলে যাওয়াটা সত্যিই খুব কষ্টের।
মাইক্রোসফ্ট থেকে সদ্য চাকরিচ্যুত আরেক কর্মী বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি আমাদের মতো অভিবাসীদের ওপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলছে। আমরা একপ্রকার অচেতন অবস্থার মধ্যে আছি বলে মনে হচ্ছে।
সিলিকন ভ্যালিভিত্তিক উদ্যোক্তা ও এশীয় আঞ্চলিক নেতা অজয় জৈন ভুটোরিয়া বলেন, হাজার হাজার কর্মীর চাকরিচ্যুতি সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। বিশেষ করে, যারা এইচ- ১বি ভিসায় রয়েছেন, তাদের অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। কারণ, খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাদের নতুন একটি চাকরি খুঁজে নিতে হবে, না হলে দেশে ফিরে যেতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এভাবে চাকরি চলে যাওয়া যেকোনো ব্যক্তির ও তার পরিবারের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর উচিত এইচ-১ বি ভিসার কর্মীদের জন্য বিশেষ বিবেচনা করা। শেষ কর্মদিবস কয়েকমাস পিছিয়ে দেওয়া হলে এ শ্রেণীর কর্মীরা বেশ উপকৃত হতেন।
জানা যায়, গ্লোবাল ইন্ডিয়ান টেকনোলজি প্রফেশনালস অ্যাসোসিয়েশন (GITPRO) ও ফাউন্ডেশন ফর ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ডায়াস্পোরা স্টাডিজ (এফআইআইডিএস) রোববার (২২ জানুয়ারি)রবিবার চাকরিচ্যুত ভারতীয় নাগরিকদের সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছে। ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস (ইউএসসিআইএস) এর নীতিনির্ধারক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের সঙ্গে মধ্যস্ততা করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে এফআইআইডিএস।
এফআইআইডিএসের কর্মকর্তা খান্দে রাও কাণ্ড বলেন, প্রযুক্তিশিল্পে ব্যাপক ছাঁটাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে এ বছরের জানুয়ারি মাসটি প্রযুক্তিখাতের কর্মীদের জন্য নৃশংস একটি সময়। অনেক মেধাবী ব্যক্তি তাদের চাকরি হারিয়েছেন। যেহেতু প্রযুক্তিশিল্পে ভারতীয় অভিবাসীদের আধিপত্য রয়েছে, তাই সামগ্রিক প্রভাবটা তাদের ওপরই সবচেয়ে বেশি পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, ট্যাক্স দেওয়াসহ মার্কিন অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে অবদান রাখা আইনি এসব অভিবাসীদের পারিবারিক জীবন হুমকির মধ্যে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অজয় জৈন ভুতোরিয়া বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন প্রক্রিয়াটি নতুনভাবে সাজানো দরকার।
জানা গেছে, চাকরিচ্যুত ভারতীয় আইটিকর্মীরা যে ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে, তা সমাধানের উপায় খুঁজতে একাধিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হয়েছে। এসব গ্রুপের একটিতে ৮০০ জনেরও বেশি ভারতীয় আইটিকর্মী রয়েছেন, যারা দেশে উপস্থিত শূন্য পদগুলোর কথা নিজেদের মধ্যে প্রচার করছেন।
অন্য একটি গ্রুপে বিভিন্ন ভিসার বিকল্প নিয়ে আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিবাসন আইনজীবী চাকরিচ্যুতদের স্বেচ্ছায় সেখানে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন।