স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের প্রয়াণের চল্লিশ দিন পূর্ণ হলো শুক্রবার (১২ ফেব্র“য়ারি) ২০২১। এদিন তাকে নিয়ে স্মরণ সভার আয়োজন করে আনন্দ আলো। শুক্রবার বিকেলে চ্যানেল আইয়ের স্টুডিওতে আয়োজিত এই স্মরণ সভা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ, চ্যানেল আইয়ের পরিচালক, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু, শিল্পী মো. খুরশীদ আলম, কবি হাসান হাফিজ, কবি আসলাম সানী, অন্য প্রকাশের কর্ণধার মাজহারুল ইসলাম, ছড়াকার আমীরুল ইসলাম, পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার, শিশু সাহিত্যিক আনজির লিটন, আনন্দ আলোর সম্পাদক রেজানুর রহমান, কণ্ঠশিল্পী কোনালসহ শিল্পসাহিত্য অঙ্গণের গুণীজনরা। স্মরণ সভা অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত লেখিকার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করেন অতিথিরা। রাবেয়া খাতুনকে নিয়ে স্মৃতিচারণ কওে সেলিনা হোসেন বলেন, ‘রাবেয়া আপা ছিলেন আমার কাছে এক সাহসের নাম। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, তখন তার ‘মধুমতি’ উপন্যাসটি পড়ে আমি আলোড়িত হয়েছিলাম। তিনি এই উপন্যাসটিতে যেভাবে বাংলার জনজীবনকে তুলে ধরেছিলেন, সেটা তখনকার সাহিত্যে বিরল। আমি তখন থেকেই রাবেয়া আপাকে গুরু মনে করতাম।’
স্মরণ সভা অনুষ্ঠানে রাবেয়া খাতুনের সাথে ব্যক্তিগত মধুর কিছু স্মৃতির কথা বনর্ণা করতে গিয়ে শাইখ সিরাজ বলেন, ‘সাগরের মা-ই ছিলো আমাদের সবার মা। তিনি আমাদের কাছে ছিলেন একটা বটগাছের মতো। সাহিত্য ও সমাজে রাবেয়া খাতুনের অবদান সম্পর্কে শাইখ সিরাজ আরো বলেন, আজকে বাংলা সাহিত্য যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, যদি নারী স্বাধীনতার কথা বলি- তাহলে রাবেয়া খাতুন, জুবাইদা গুলশান আরা, সেলিনা হোসেনসহ আরো যারা সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশক থেকে লিখে আসছেন, তাদের অবদান সবার উপরে। কারণ আজকে যে নারী স্বাধীনতা দেখছে, তার ভিত কিন্তু লেখনীর মাধ্যমে তারাই ধীরে ধীরে তৈরী করেছেন।’
রাবেয়া খাতুনের জামাতা মুকিত মজুমদার বাবু মনে করেন ‘রেখে যাওয়া সৃষ্টিকর্মের মধ্য তিনি বেঁচে থাকবেন সবার মাঝে। পরিবারের সদস্য হিসেবে তিনি বলেন, প্রিয় মানুষকে হারানোর শোক ভোলার নয়। কিন্তু আমরা শোককে শক্তিতে পরিণত কওে সেই মানুষটির চিন্তা ভাবনা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। সৃষ্টিশীল মানুষের মৃত্যু নেই। তিনি বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টিকর্মের মধ্যে। আমরা যেন তাকে সেভাবেই স্মরণ রাখি।’ অন্য প্রকাশের কর্ণধার মাজহারুল ইসলাম জানান, অন্য প্রকাশ থেকে শিগগির রাবেয়া খাতুনের উপর স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হবে। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, শুধু সাহিত্য নয়, রাবেয়া খাতুন চলচ্চিত্রকেও সমৃদ্ধ করেছেন। অতীতে যেমন তার গল্পে বেশকিছু নাটক সিনেমা নির্মিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও সে ধারা অব্যাহত থাকবে।
১৯৩৫ সালে বিক্রমপুরে জন্ম গ্রহণ করেন রাবেয়া খাতুন। লেখালেখির পাশাপাশি শিক্ষকতা এবং সাংবাদিকতাও করেছেন তিনি। উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথাসহ চলচ্চিত্র ও নাট্য জগতেও বিচরণ রাবেয়া খাতুনের। তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস নিয়ে নির্মিত ‘মেঘের পরে মেঘ’ জনপ্রিয় একটি চলচ্চিত্র। ‘মধুমতি’ এবং ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টিও প্রশংসিত হয়েছে সব মহলে। তার স্বামী প্রয়াত এটিএম ফজলুল হক ছিলেন দেশের চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রথম পত্রিকা সিনেমার সম্পাদক ও চিত্রপরিচালক। বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’ এর পরিচালকও তিনি। ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই এটিএম ফজলুল হক ও রাবেয়া খাতুনের বিয়ে হয়। তাদের চার সন্তানের মধ্যে ফরিদুর রেজা সাগর ও ফরহাদুর রেজা প্রবাল, মেয়ে কেকা ফেরদৌসী ও ফারহানা কাকলী।
মেয়েদের জামাতা ইমপ্রেস গ্র“পের পরিচালক মুকিত মজুমদার বাবু ও জহির উদ্দিন মাহমুদ মামুন। বাংলা একাডেমি, চলচ্চিত্র জুরী বোর্ড, লেডিস ক্লাব, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, মহিলা সমিতিসহ অসংখ্য সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন রাবেয়া খাতুন। তার প্রকাশিত পুস্তকের সংখ্যা একশ’রও বেশি।
সাহিত্যচর্চার জন্য পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৭), একুশে পদক (১৯৯৩), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৩), নাসিরুদ্দিন স্বর্ণ পদক (১৯৯৫), হুমায়ূন স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৯), কমর মুশতারী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৯৪), শের-ই-বাংলা স্বর্ণ পদক (১৯৯৬), ঝষিজ সাহিত্য পদক (১৯৯৮), লায়লা সামাদ পুরস্কার (১৯৯৯) ও অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯)। ছোট গল্পের জন্য পেয়েছেন নাট্যসভা পুরস্কার (১৯৯৮)।
সায়েন্স ফিকশন ও কিশোর উপন্যাসের জন্য পরস্কৃত হয়েছেন শাপলা দোয়েল পুরস্কার (১৯৯৬), অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার (১৯৯৮), ইউরো শিশু সাহিত্য পুরস্কার (২০০৩)। ছোটগল্প ও উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ হয়েছে প্রেসিডেন্ট (১৯৬৬), কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি (২০০৩), মেঘের পরে মেঘ (২০০৪), ধ্রবতারা, মধুমতি (২০১০)।
টিভি নাটকের জন্য পেয়েছেন টেনাশিনাস পুরস্কার (১৯৯৭), বাচসাস (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি) পুরস্কার, বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন মিলেনিয়াম অ্যাওয়ার্ড (২০০০), টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাওয়ার্ডস (২০০০) ইত্যাদি পুরস্কার।