হঠাৎ করে বুকে ব্যথা শুরু হলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। বয়স ৩০ হলে বুকে বা বুকের আশেপাশে যে কোন ধরনের ব্যথা বা অস্বস্তি হলে সেটা প্রথমে ধরে নিতে হবে হার্টের ব্যথা। কারণ হার্টেরব্যথা অন্য কোনো ব্যথা থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । এজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, হার্টের সমস্যায় মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেশি। এবং হার্টের রোগের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো দ্রুত চিকিৎসা না নিলে হার্টের মাংসপেশী দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঘটনা-১ : সাদেক সাহেবের বয়স সাঁইত্রিশ। অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমন সময় বুকে ব্যথা অনুভব করলেন। কি করা উচিত বুঝে ওঠার আগেই ঘরের মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। তাঁকে দ্রুত হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হলো। সেখানে একটি ইসিজি করেই ডিউটিরত ডাক্তার ফোন দিয়ে বললেন- ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক! আমি ৩০০ মিগ্রাম ডিসপ্রিন (এ্যাসপিরিন), ১৮০ মিগ্রাম টিকারেল এবং ৮০ মিগ্রাম এ্যাটোভা খাইয়ে দিয়ে দ্রুত সিসিইউ তে পাঠাতে বললাম। এদিকে এ্যানজিওগ্রাম করার জন্য ক্যাথল্যাব টীম কে প্রস্তুত হতে বললাম। রোগী সিসিইউ তে প্রবেশ করা মাত্র দেখি বুকে তীব্র ব্যথা, শরীর ঘর্মাক্ত, প্রেসার কম, পালসের গতি বেশি। আমি পুরো বিষয়টি তাঁর স্ত্রীকে বলা মাত্র তিনি বললেন, ‘সবচেয়ে যা ভাল সেটা করুন, আমাদের কোন আপত্তি নেই। ওকে বাঁচান প্লিজ!’ অনতিবিলম্বে সাদেক সাহেবকে ক্যাথল্যাবে নিয়ে গেলাম। দ্রুত এ্যানজিওগ্রাম করে দেখি তাঁর সবচেয়ে বড় রক্তনালী (LAD) শতভাগ বন্ধ হয়ে আছে। আমি তৎক্ষণাৎ সেটি খুলে দিয়ে যাতে আবার বন্ধ না হতে পারে সেজন্য একটি রিং (Stent) বসিয়ে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সাদেক সাহেবের বুকের ব্যথা কমে গেল, ইসিজি স্বাভাবিক হয়ে এলো, প্রেসার বাড়ল, পালস সীমার ভিতর চলে এলো। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে ২০ মিনিট সময় ব্যয় হলো। সিসিইউ তে একদিন রেখে মোট তিন দিনের মাথায় তাঁকে ছুটি দিয়ে দেয়া হলো। পরবর্তী ফলো আপে দেখা গেল তাঁর হার্টেরপাম্পিং সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। পুরোপুরি উপসর্গমুক্ত। গত নয় বছর হয়ে গেল তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। ওষুধ নিয়মিত খাচ্ছেন।
ঘটনা ২ : মোসলেম উদ্দিন সাহেব। বয়স ষাট। ডায়াবেটিক রোগী। রাত দশটা থেকে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট। বুকে কোনো ব্যথা নেই। পরিবারের লোকজন ভাবল অ্যাজমা অ্যাটাক হয়েছে। তাঁরা মোসলেম উদ্দিনকে নিয়ে রাত ১টার দিকে জরুরি বিভাগে নিয়ে এলেন। ইসিজি করা মাত্র দেখা গেল হার্ট অ্যাটাক। রোগীকে তৎক্ষনাৎ ভর্তি হতে বলা হলো। কিন্তু রোগী বা পরিবার রাজি না। তাঁদের বক্তব্য “ছাছের কষ্ট অইছে, ছাছের ওছুদ দ্যান!” যাই হোক অনেক বুঝাবার পরে এবং নেবুলাইজার দেবার পরেও যখন দেখল শ্বাসকষ্ট কমছে না, তখন বাধ্য হয়েই মোসলেম উদ্দিনকে সিসিইউ তে ভর্তি করা হলো। ডিউটিরত কার্ডিওলজিস্ট আমাকে রাত দেড়টায় মোসলেম সাহেবের খবরটি দিলেন। বললাম যদি তাঁরা রাজি থাকেন তাহলে জরুরি ব্লক অপসারণ (primary angioplasty) করা যেতে পারে। কিন্তু কোনো মতে রোগী বা তাঁর পরিবার রাজি হলেন না। বাধ্য হয়েই দ্বিতীয় অপশন streptokinase দিতে বললাম। কিন্তু ওষুধ ব্লক অপসারণে ব্যর্থ হলো। সকালের দিকে রোগীর পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হতে শুরু করল। প্রেসার কমে গেল, পালস কমে গেল, কিডনীর কার্যকারিতা কমতে শুরু করল। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা অনেক কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই লাইফ সাপোর্টে দেয়া হলো। দুদিন লড়াই করে প্রচুর বিল পরিশোধ করে রোগীর লোকজন হৃদস্পন্দনহীন মোসলেম উদ্দিনকে নিয়ে বাড়ি চলল।
শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ: ১। ৩০ বছর বয়সের কোনো ব্যক্তির বুকে বা বুকের আশেপাশে কোনো ব্যথা হলে অবশ্যই গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। ২। ডায়াবেটিক রোগীর স্নায়ু দুর্বল বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেক সময় রোগী ব্যথা অনুভব করেন না। তাই হার্ট অ্যাটাকের ব্যথাও ঠিকমত বুঝতে পারেন না। ৩। বুকে ব্যথা অনুভব না করলেও রোগী বুকে অস্বস্তি বা চাপ বা শ্বাসকষ্ট অনুভব করতে পারেন। সেটাকে অ্যাজমার এ্যাটাক হিসেবে ভুল বুঝলে চলবে না। ৪। যে কোনো ধরনের হঠাৎ তীব্র অসুস্থতা বোধ করলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। ইসিজি করে ডাক্তার দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে। ৫। জরুরি অ্যানজিওপ্লাস্টি হলো হার্ট অ্যাটাকের আধুনিক চিকিৎসা। এতে মৃত্যুঝুঁকি কমে এবং পাম্পিং ক্ষমতা বজায় থাকে। যেকোনো ভাবে হোক সম্ভব হলে এটি প্রয়োগ করতে হবে। ৬। চিকিৎসকের উপর আস্থা রাখতে হবে। চিকিৎসকের উপদেশকে মেনে নিয়ে সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। অযথা সময়ক্ষেপণ করে পুরাতন চিকিৎসায় ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না। ৭। রাত দিন যখনই হোক সমস্যার সাথে সাথে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে যেতে হবে।
লেখক : সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ধানমণ্ডি, ঢাকা।