মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক দেশের থেকে বাংলাদেশের সফলতা বেশি। তারপরও এখনো দেশে প্রতি দুই ঘণ্টায় একজন গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু হয়। একাধিক গবেষণা তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর চার হাজার ৭২০ জন গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু হয়। সে হিসেবে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৩ জন মারা যান।
এমনি অবস্থায় আজ ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালিত হচ্ছে। ১৯৮৭ সালে কেনিয়ার নাইরোবিতে উন্নয়ন-সহযোগীদের বৈঠকে আন্তর্জাতিক ভাবে নিরাপদ মাতৃত্ব বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এরপর ১৯৯৭ সালে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই বছর থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস ও নবজাতকের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। আর গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী সময়ে সকল নারীর জন্য নিরাপদ স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করাই হলো নিরাপদ মাতৃত্ব। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে সরকার মিডওয়াইফ’র মাধ্যমে নিরাপদ মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। জরুরি প্রসব সেবাসহ প্রসবকালীন জটিলতায় প্রয়োজনীয় সেবা চালু করেছে। তবে এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হলেও কাঙ্খিত অগ্রগতি হয়নি।
কাঙ্খিত অগ্রগতি না হলেও দেশে গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে বলে তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ ম্যাটারনাল মর্টালিটি অ্যান্ড হেলথ কেয়ার সার্ভে (বিএমএমএস)। তাদের তথ্যানুযায়ী, ৯০-এর দশকে প্রতি এক লাখ জীবিত শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ৫৭৪ জন সন্তানসম্ভবা নারীর মৃত্যু হতো। যা কমে প্রতি লাখে ১৬৫ জনে দাঁড়িয়েছে। সে হিসাবে ৯০-এর দশকের তুলনায় মাতৃমৃত্যু ৭০ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে। তবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, সরকার মাতৃমৃত্যু হার লাখে ৭০ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে।
জাতীয় মাতৃস্বাস্থ্য কৌশলপত্র অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ৪৭ দশমিক এক শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। দক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে প্রসবের হার ৫০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। পাশাপাশি মাতৃমৃত্যুর হার এবং নবজাতকের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে হবে।
গর্ভকালীন সময়ে কমপক্ষে ৪ বার গর্ভকালীন সেবা গ্রহণের হার ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ থেকে শতভাগে উন্নীত করতে হবে। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ সেই লক্ষ্য অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি হাসপাতাল, চিকিৎসা, পর্যাপ্ত ডাক্তার ও আধুনিক যন্ত্রপাতির এখনো অভাব রয়েছে। মা ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্র, স্যাটেলাইট ক্লিনিক এবং বিভিন্ন এনজিও বা সংস্থার মা ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর অবস্থাও খুব খারাপ। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত পদক্ষেপের অভাবও দায়ি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কাজী আ খ ম মহিউল ইসলাম বলেন, দেশে মোট মাতৃমৃত্যুর ৭৩ শতাংশই ঘটে প্রসব-পরবর্তী সময়ে। যাদের ৫৬ ভাগই মারা যায় প্রসবের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। এসব মাতৃমৃত্যুর ৩১ শতাংশই ঘটে রক্তক্ষরণের কারণে। ২৪ ভাগ মৃত্যুর জন্য দায়ী খিঁচুনি বা একলাম্পশিয়া। এছাড়া ৩ শতাংশ মায়ের মৃত্যু ঘটে বাধাগ্রস্ত বা অবিরাম প্রসব ব্যথার কারণে। মোট মাতৃমৃত্যুর ৫৩ ভাগই ঘটে থাকে বাড়িতে প্রসবের কারণে। তাই বাড়িতে প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত ক্লিনিক ও হাসপাতালে নিতে হবে।
নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধি, নিরাপদ প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং সবার জন্য পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে মেরি স্টোপস-বাংলাদেশ। মেরি স্টোপস-বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি লিড (প্রধান) মনজুন নাহার জানান, নিরাপদ মাতুত্ব নিশ্চিত করতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় বরিশাল, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার ৩৭টি উপজেলার ৩২৩টি ইউনিয়নে কাজ করছে মেরি স্টোপস ও সুশীলন। যে কারণে ইউনিয়ন পরিষদগুলো জাতীয় বাজেটের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে এ খাতে পৃথক বরাদ্দ রাখছে। একইসঙ্গে সেবা নিশ্চিত করতে ইউনিয়ন পরিষদ এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সমন্বিত পদক্ষেপ নিচ্ছে। ফলে তৃণমূলে সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। সারাদেশে এ ধরণের উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার ষাট গম্বুজ ইউনিয়নে এখন মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার শূন্য। সেখানে মাতৃত্বকালীন সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এই সফলতার পেছনে গত তিন বছরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদের নিজস্ব তহবিল থেকে পৃথক বাজেট বরাদ্দ কাজ করেছে।
এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সমন্বিত পদক্ষেপও তৃণমূলে সেবা নিশ্চিত করতে বড় ধরণের ভূমিকা রেখেছে। শুধু ষাট গম্বুজ ইউনিয়ন নয়, বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে প্রজনন স্বাস্থ্য সেবায় একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
চিকিৎসকদের মতে, গর্ভাবস্থায় সব নারীরই বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়। এ সময়ে অনেক মায়েরই স্বাস্থ্যগত জটিলতা দেখা দেয়। জীবনের ঝুঁকিও থাকে। সব নারীরই গর্ভাবস্থার পুরো সময়টা পুষ্টিকর খাদ্য এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বিশ্রাম প্রয়োজন।
গর্ভকালীন টিটি টিকা দেওয়া, ওজন মাপা, স্বাস্থ্যশিক্ষা দেওয়া, রক্তস্বল্পতা বা শরীরে রক্ত কম কি না তা পরীক্ষা করা, রক্তচাপ পরিমাপ করা, পা অথবা মুখ ফুলে গেলে পানি আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা, শারীরিক অন্য কোনো অসুবিধা আছে কি না তা পরীক্ষা করা জরুরি। এই সেবা নিশ্চিত করতে স্বামীসহ পরিবারের সকলের সাবধানতা ও সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।