শীত মৌসুম চলছে। এ সময় শ্বাসতন্ত্রের রোগ বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে অ্যাজমা ও সিওপিডি রোগীদের সমস্যা বেড়ে যায়। আবার নিউমোনিয়াও দেখা দেয়।
* মৌসুম পরিবর্তনের এ সময়ে কাশি ও শ্বাসকষ্টের রোগ বেড়ে যাওয়ার কারণ কী?
** তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কমে গিয়ে বায়ুমণ্ডল শুষ্ক হয়ে যায় ও ধুলাবালি বেড়ে যায় এবং ফুলের পরাগ রেণু ও ড্রপলেট ইনফেকশন নাক-মুখে গিয়ে কাশি ও শ্বাকষ্টের মতো সমস্যা হচ্ছে। আমাদের দেশে কাশি ও শ্বাসকষ্টের অন্যতম কারণ অ্যাজমা, সিওপিডি ও ফুসফুসে ক্যানসার। এগুলো সবই নন-ইনফেকশাস বা নন-কমিউনেকেবল ডিজিজ। অর্থাৎ জীবাণুর মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনের ছড়ায় না।
জীবাণু দ্বারা ছড়ায় সংক্রামক রোগ হচ্ছে নিউমোনিয়া ও ফুসফুসে যক্ষ্মা। এ ছাড়াও ফুসফুসের পর্দায় পানি জমে গেলে যাকে প্লুরাল ইফিউশন বলে এবং ফুসফুসে বাতাস ঢুকলে যাকে নিউমোথোরাক্স বলে, তা থেকেও কাশি ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। তীব্র শ্বাসকষ্টের অন্যতম কারণ এআরডিএস নামক একটি সমস্যা। এ ছাড়া বুকের পাজড়ের মাংসপেশি ও হাড়ের সমস্যা যাকে নিউরোমাসকুলার ডিজিজ বলে এবং ইমিউনোলজিক্যাল কারণেও শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে।
* হঠাৎ কারও তীব্র শ্বাসকষ্ট হলে কী করা উচিত?
** পালস অক্সিমিটারে অক্সিজেনের পরিমাণ ৯০-এর নিচে নামলে, পালস রেট বা নাড়ির স্পন্দন প্রতি মিনিটে ১০০-এর বেশি হলে এবং রোগী যদি এক নিশ্বাসে একটি বাক্য বলে শেষ করতে না পারে, তাহলে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ধরে নেওয়া যায়। যারা অ্যাজমা রোগী তাদের সারা বছর ধরে অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এ মৌসুমে শ্বাককষ্ট বেড়ে যেতে পারে। একইভাবে তাপমাত্রার পরিবর্তনে ফ্লু অ্যাটাক থেকেও সিওপিডির তীব্রতা বেড়ে গিয়ে শ্বাসকষ্ট বাড়ে।
এ ছাড়া যাদের ব্রঙ্কিয়েকটেসিস নামক সমস্যা আছে তাদের নিউমোনিয়ার মতো সুপার ইনফেকশন হয়েও শ্বাসকষ্ট হয়। এ রোগীদের আমরা বাসায় নেবুলাইজার মেশিন, অক্সিজেন সিলিন্ডার বা বাইপেশ মেশিন এবং ইনহেলার কাছে রাখতে বলি। সালবিউটামল দিয়ে ১৫-২০ মিনিট পরপর নেবুলাইজার করতে হবে। যারা ইনহেলার নেন তারা সালবিউটামল ইনহেলার ২ পাফ করে ২০ মিনিট পরপর তিনবার নেওয়ার পরও শ্বাসকষ্ট না কমলে নিকটস্থ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে যেতে হবে। মাঝরাতে কারো শ্বাসকষ্ট হলে এক মুহূর্ত দেরি না করে ইমার্জেন্সিতে যেতে হবে। এ সময় পালস অক্সিমেটার দিয়ে অক্সিজেনের পরিমাণ ৯০-এর উপরে থাকল কিনা তাও দেখতে হবে।
* অ্যাজমা রোগীরা শীতের প্রস্তুতি কীভাবে নেবেন?
** এ রোগীদের অ্যাজমা যেন সারা বছর ধরেই সুনিয়ন্ত্রণে থাকে সে লক্ষ্য প্রতিরোধ করে এমন ইনহেলার যেমন বেকলোমিথাসন, ফ্লুটিকাসন ও সালমেট্রল গ্রুপের ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। অ্যাজমা অ্যাটাক যেন না হয় সে জন্য ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সচেষ্ট থাকতে হবে। এ জন্য শীতের শুরুতেই প্রতি বছর ফ্লু ভ্যাকসিন ও পাঁচ বছর পরপর নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন নিতে হবে। অ্যাজমা রোগীদের নিজেদেরই জানতে হবে কিসে তার অ্যাজমা ট্রিগার করে বা বেড়ে যায়। এ বিষয়গুলো অবশ্যই তাকে পরিহার করে চলতে হবে। গরম কাপড় পরিধান করে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। ব্যায়ামে অ্যাজমা রোগীদের কোনো বিধিনিষেধ নেই। শীতের কিছু সবজিতে অ্যাজমা রোগীদের অ্যালার্জি হয়ে থাকে যাকে হাইপারসেনসিটিভিটি রিঅ্যাকশন বলে, তা এ রোগীদের খাওয়া যাবে না।
সামুদ্রিক লোনা পানির মাছ অনেকের অ্যাজমা অ্যাটাক বাড়াতে পারে। সুষম খাদ্য গ্রহণের দিকে নজর দিতে হবে। অ্যাজমা রোগীদের অ্যাজমার কারণে মৃত্যুঝুঁকি নাই বললেই চলে। তবে কিছু সংখ্যক রোগীর জটিল বা ব্রিটল অ্যাজমা থাকে তাদের হঠাৎ অক্সিজেনের পরিমাণ অনেক কমে গিয়ে আইসিইউ ও ভেন্টিলেশন সাপোর্ট লাগে। একবার যাদের হঠাৎ তীব্র অ্যাজমা অ্যাটাক হয় তাদের বারবার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তারা অবশ্যই ঠান্ডা, ধোঁয়া, ধুলা পরিহার করবেন এবং চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ করবেন।
* অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টের ওষুধ দীর্ঘদিন খেলে কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়?
** ডাক্তারের পরামর্শে নির্দিষ্ট ডোজে ও নির্দিষ্ট সময়ে এ ওষুধগুলো গ্রহণ করলে কোনোই সমস্যা হবে না। কিছু ওষুধ যেমন-অ্যামাইনোফাইলিন ও সালবিউটামলে কারো কারো বুক ধড়ফড়, হাত-পা কাঁপা, নাড়ির গতি বেড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ডোজ এডজাস্ট বা ওষুধ বাদ দিতে হবে। স্টেরয়েড ইনহেলার মুখের ভেতর ঘা বা ওরাল থ্রাস হতে পারে। এ জন্য ইনহেলার নেওয়ার পর মুখ কুলকুচি করতে হবে।
কেউ যদি স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ প্রতিদিন ২০০০ মাইক্রোগ্রামের অধিক গ্রহণ করে তাহলে শ্বাসনালি থেকে তা রক্তে শোষিত হয়ে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও এন্ড্রেনাল ইনসাফেয়েন্সি রোগ হতে পারে। তবে এটি হওয়ার আশঙ্কা নগণ্য। এ জন্য অ্যাজমা সুনিয়ন্ত্রণে রেখে ওষুধের ডোজ কমিয়ে দিতে হবে। সমস্যা হয় সেসব রোগীর যারা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বছরের পর বছর মুখে খাওয়ার স্টেরয়েড খান।
এদের ওজন বেড়ে যায়, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হাড় নরম ও ভঙ্গুর হয়ে প্যাথলজিক্যাল ফ্র্যাকচার বা হাড় স্বল্প আঘাতেই ভেঙে যায়। কেউ কেউ আবার আর্য়ুবেদ ওষুধ খেয়ে আরাম পেয়ে এ ওষুধ চালিয়ে যান। এতে স্টেরয়েডের গুঁড়া মিশানো থাকে ফলে ওপরের সমস্যাগুলো ছাড়াও রোগ-জীবাণু দ্বারা বারবার আক্রান্ত হয়। অ্যাজমায় আক্রান্ত নারীরা ওষুধ খেয়ে গর্ভধারণ করতে পারেন। এতে তার ও অনাগত সন্তানের কোনোই ক্ষতি হয় না।
* যারা লং কোভিডে আক্রান্ত তারা ফুসফুসের যত্নে কী করবেন?
** এ রোগীদের অ্যাজমা বা সিওপিডি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, এদের ফুসফুস ফাইব্রোসিস বা শক্ত হয়ে যায় বলে শ্বাসকষ্টের আশঙ্কা বাড়ে। এ রোগীরা বর্তমানে ডিফিউজ প্যারেনকাইমাল লাং ডিজিজ নাশক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ধরনের রোগী বর্তমানে আমরা অনেক দেখতে পাচ্ছি। এদের স্টেরয়েড, প্রদাহ নামক ওষুধ ও এন্টিফাইব্রোটিক ওষুধ যেমন-পিরফেনিডোন ও নিনটেডানিব দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয় যা বাংলাদেশেও সহজলভ্য।
এ রোগের সঙ্গে যাদের জয়েন্ট ও মাংসপেশির রোগ বা কোলাজেন ডিজিজ আছে তাদের মাইক্রোওপিয়েড দিয়ে ট্রিটমেন্ট করা হয়। কোভিডকালীন মাস্ক পড়ে অ্যাজমা ও সিওপিডি রোগীর রোগ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। এ অভ্যাস অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। ফুসফুসে কোনো রোগ হলে শিগ্গির বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সুচিকিৎসা নিতে হবে।