হ্যাঁ, এটা এক ধরনের রোগ। অনেকেই প্রায়ই কানের ভিতর বিশেষ কোনো শব্দ শুনতে পান, যা শব্দহীন অবস্থায় তথা নীরব পরিবেশে বা রাতে বেশি শোনেন। এ ক্ষেত্রে শোঁ শোঁ, ভো ভো, শিন শিন, ঝিন ঝিন ইত্যাদি শব্দ শোনা যায়।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, চিকিৎসকেরা এই শব্দ কোন যন্ত্র দিয়েও শুনতে পান না। এই শব্দ শুধু রোগী নিজে শুনতে পান। এমনকি কোন আত্মীয়–স্বজনেরাও এই শব্দ শুনতে পান না। এই ধরনের সমস্যায় চিকিৎসক কেবল রোগীর কথার ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
এই ধরনের সমস্যাকে চিকিৎসকেরা টিনিটাস বলে থাকে। সাধারণত যাদের টিনিটাস থাকে, তাদের এই সমস্যার পাশাপাশি মাথা ঘুরানো বা ভার্টিগোও থাকতে পারে। এই ধরনের সমস্যায় দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ না নিলে পরবর্তীতে জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
লক্ষণ
১. কানে শোঁ শোঁ, ভন ভন,ঝি ঝি, ফ্যান বা ঝড়ের মতো শব্দ অনুভব হবে
২. মাথা ঘুরানো
৩. কানে কম শোনা
৪. বমি বমি ভাব
৫. অনিদ্রা
৬. খিটখিটে মেজাজ
৭. ডিপ্রেশন ও আত্মহত্যার প্রবণতা
৮. মাথা ধরাসহ শরীরে আরও নানাবিধ সমস্যা
কানের শোঁ শোঁ শব্দের কারণ
আমাদের অন্তঃকর্ণের ভেসটিবুল ও সেমি সার্কুলার ক্যানাল শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করার প্রধান অঙ্গ। বহিঃকর্ণ, মধ্যকর্ণ ও অন্তঃকর্ণের অনেক সমস্যা থেকে কানের ভেতরে ভারসাম্য রক্ষার পদ্ধতিতে সমস্যা হতে পারে, যার ফলে মাথা ঘুরাতে পারে এবং ভোঁ ভোঁ শব্দ করতে পারে। তবে অনেক সময় তা স্নায়ুতন্ত্রের সাথেও সম্পর্কিত থাকে। কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ দেওয়া হলো-
১. কানের ভেতরে ময়লা জমে গেলে
২. বহিঃকর্ণের ইনফেকশন
৩. ঘন ঘন কান পাকা
৪. স্ট্রোক
৫. মাদকাসক্ত
৬. নাকের হাড় বাঁকা থাকা
৭. কানের পর্দা না থাকা বা ছিদ্র হওয়া
৮. কানের ভেতর টিউমার
৯. নাকের এবং গলার ক্যান্সার
১০. অতিরিক্ত মেডিসিন খেলে
১১. কিডনিতে সমস্যা হলে
১২. শরীরে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়লে
১৩. কেমোথেরাপি নিলে
১৪. কানে জোড়ে থাপ্পড় লাগলে বা ব্যথা পেলে
১৫. কানের ভেতর হাড় শক্ত হয়ে যাওয়া (অটোস্কোরোসিস)
১৬. অন্তঃকর্ণের প্রেসার বেড়ে গেলে (মেনিয়ার্স ডিজিজ)
১৭. কোলেস্টিয়াটমা ও কানের মধ্যে পানি বা ফ্লুইড জমে থাকলে
১৮. মধ্যকর্ণের ইনফেকশন যা নাকের পেছন দিয়ে কানের ভেতরে যায়
১৯. সাইনাসের দীর্ঘদিনের ইনফেকশন সমস্যা থেকেও মাথা ঘুরানোসহ কানে শোঁ শোঁ শব্দ হতে পারে
২০. ঘনঘন অথবা বেশি মাত্রায় সর্দি-কাশি হয়ে ইউস্টিশিয়ান টিউবের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে কানে শব্দ এবং মাথা ঘুরতে পারে
টিনিটাস সাধারণত তিন ধরনের হয়। যেমন:
১. সাবজেক্টিভ
বাইরের কোন কোলাহল ছাড়া রোগী যখন কোন শব্দ শুনতে পায়। এটি সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর অথবা একটানা শুনতে পারে। ফলে রোগীর ঘুমাতে ও কাজে মনোনিবেশ করতে অসুবিধা হয় এবং মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
২. অবজেক্টিভ
এই ধরনের টিনিটাস রোগীর নিজের শরীর থেকে অনুভূত হয়। যেমন: শরীরের রক্তের প্রবাহ, মাংসপেশির সংকোচন বা প্রসারণ ইত্যাদির কারণে।
৩. অডিটরি হ্যালুসিনেশন
রোগী নির্দিষ্ট সময় পর পর কানে অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পায়। বাস্তবে যার কোন অস্তিত্ব নেই। ব্রেনের স্নায়ুকোষ হতে উৎপন্ন এই ধরনের টিনিটাস সাধারণত মানসিক রোগীদের বেশি দেখা যায়।
মাথা ঘোরালে এবং শোঁ শোঁ শব্দ হলে করণীয়
কানের শোঁ শোঁ শব্দ বা টিনিটাসের দুই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে-
১. মেডিসিন ও ঘরোয়া পদ্ধতি
সমস্যা বেশি থাকলে একা একা চলাফেরা ঠিক নয়। বিশ্রাম জরুরি এবং অন্যান্য কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এই সমস্যায় ঘন ঘন বমি হলে শরীরের ভেতরে পুষ্টি, লবণ ও পানির ঘাটতি যাতে না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কখনো কখনো এই সমস্যার জন্য টিনিটাস থেরাপি বা কানে এক ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তাতে শব্দ পুরোপুরি বন্ধ না হলেও রোগী উপশম বোধ করেন। এরপরও সমস্যার উন্নতি না হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
২. সার্জারি বা অপারেশন
কানের বিশেষ কিছু সমস্যা, যেমন: কানের পর্দা ছিদ্র, টিউমার, হাড়ের সমস্যা, ক্যান্সার, কানে ফ্লুইড জমা ইত্যাদি কারণে কানে শোঁ শোঁ শব্দ হলে সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসা করা।
প্রতিকার
এই ধরনের সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে হলে –
১. ঠান্ডা–সর্দি লাগলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে।
২. অযথা কান চুলকানো যাবে না।
৩. অতিরিক্ত ঠান্ডা খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
৪. নাক-কানের অসুখে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে।
লেখক: নাক, কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞ
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (ইএনটি), ডিসিএমসি (এক্স)
কনসালটেন্ট, প্লাটিনাম হাসপাতাল,পান্থপথ, ধানমন্ডি