কোনো জীবের সামগ্রিক ডিএনএ হলো জিনোম। জীবের বৃদ্ধি, প্রজনন, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে এই জিনোম। ডিএনএ-র মাধ্যমেই জীবের বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়।
ফলে জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্যগুলো ধরা পড়ে, এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য অতীব জরুরি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার এই জিনোম সিকোয়েন্স নিয়ে জোরেশোরে গবেষণা চালাচ্ছে। এই গবেষণায় অর্থায়ন করছেন সাবেক আমিরের স্ত্রীও।
দেশটির গবেষকরা কয়েক বছর ধরে কাতারের মানুষ প্রত্যেকে একে অন্যের সঙ্গে কিভাবে সম্পর্কিত তার বিস্তারিত রেকর্ড রেখেছেন।
এসব রেকর্ড দেশটির জিনোমিক্স পদ্ধতির উন্নতি সাধনে এগিয়ে থাকতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। কাতার মূলত একই জনসংখ্যার দেশ, যেটি একটি জেনেটিক্স পাওয়ার হাউজ হওয়ার প্রত্যাশা রাখে।
কাতারের জিনোম প্রোগ্রামের আওতায় এরই মধ্যে প্রায় দশ জনে একজনের জিনোম সিকোয়েন্স পরীক্ষা করা হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে তিনজনের মধ্যে একজনের পরীক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণও করেছে দেশটি। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করছে জিনোম সিকোয়েন্স গবেষণা সংশ্লিষ্ট কাজের।
মানুষের জিনবিন্যাসের নকশা উন্মোচন হয়েছিল ২০০৩ সালে। বিজ্ঞানীরা মানুষের জেনেটিক ব্লুপ্রিন্টকে পরিমার্জন করে প্রায় ১০ লাখ জিনোমের অনুক্রম পরীক্ষা করে। কিন্তু সারাবিশ্বে গবেষণা সমানভাবে পরিচালিত হয়নি তখন থেকে। বেশিরভাগ জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে ইউরোপীয় বংশোদ্ভূতদের ওপর। সিকোয়েন্স করা জিনোমের ১ শতাংশের কম মধ্যপ্রাচ্যের, যদিও তারা বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৫ শতাংশ।
সিস্টিক ফাইব্রোসিস একটি বংশগত রোগ যা প্রধানত শ্বসন ও পরিপাকতন্ত্রকে আক্রমণ করে। এটি একটি মারাত্মক জীবনঘাতী রোগ। যখন কোন দম্পতি উভয়েই সিস্টিক ফাইব্রোসিসের একটি করে জিন বহন করেন তখন তাদের সন্তানের মাঝে এই রোগ প্রকাশ পায়।
সাধারণত বাবা-মার মাঝে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। ইউরোপ, আমেরিকার শেতাঙ্গদের মাঝে এর প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। ফলে এই গবেষণায় জানা যেতে পারে আরবদের মাঝে এই রোগের প্রকোপ কতটা বেশি বা কম বা নাও থাকতে পারে। শুধু তাই নয় আরব জিনোম সিকোয়েন্সিং ডেটা বিশ্বে গবেষণা ও তথ্যকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
কাতার ও সৌদি আরবের অর্ধেকের বেশি মানুষের বিয়ে হয় নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে। সংযুক্ত আরব আমিরাতেও একই পরিস্থিতি। এটি করলে আত্মীয়তার সম্পর্ক আরও গাঢ় হয় এবং পরিবারের মধ্যে সম্পত্তিও সংরক্ষিত থাকে বলে ধারণা তাদের।
এছাড়া মেয়েদের বাড়ির বাইরের পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা করা নিষেধ। ফলে অনেক সময় চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো ভাইকেই বিয়ে করা তাদের একমাত্র পছন্দের হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে যারা তাদের পরিচিত গণ্ডির মধ্যে রয়েছে।
উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বিভিন্ন জিনগত বৈশিষ্ট্য বংশানুক্রমে রোগ সৃষ্টির পেছনে দায়ী। আত্মীয়দের মধ্যে জেনেটিক মিউটেশন ভাগ করে নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
যদি একটি শিশু উত্তরাধিকার সূত্রে একটি জিনের দুটি পরিবর্তিত সংস্করণ পায় (প্রতিটি পিতামাতার থেকে একটি), তবে সে যে কোন একটি রোগে ভুগতে পারে। কিছু জেনেটিক রোগ এই অঞ্চলে এতটাই সাধারণ যে চিকিৎসকরা একটি নির্দিষ্ট গোত্র বা পরিবারের সঙ্গে যুক্ত বলে এটিকে বর্ণনা করেন।
নিজ বংশ ও নিজ গোত্রে বিবাহরীতির কারণে থ্যালাসেমিয়া ও জিনগত রোগ মধ্যপ্রাচ্যে একসময় এতো বেশি প্রকট আকার ধারণ করেছিল যে বলা বাহুল্য। ফলে কাতার, কুয়েত ও সৌদি আরবে বিয়ে করতে ইচ্ছুক দম্পতিদের প্রথমে থ্যালাসেমিয়া, (একটি রক্তের ব্যাধির মতো উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কিছু রোগের সঙ্গে যুক্ত মিউটেশনের জন্য) পরীক্ষা করাতে হয়।
যাদের ঝুঁকিপূর্ণ ফলাফল রয়েছে তারা আত্মীয়র মধ্যে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন অথবা অপ্রভাবিত ভ্রূণ (সরকার কর্তৃক অর্থ প্রদান) দিয়ে ইন ভিট্রো নিষিক্তকরণ করতে পারেন।
মানুষের স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে উপসাগরীয় আরবদের জিনোম সিকোয়েন্স করা জরুরি। রোগীদের জেনেটিক সিকোয়েন্স জেনে একদিন সেটি চিকিৎসকদের জন্য সেরা ওষুধ এবং ডোজ বাছাই করতে সাহায্য করতে পারে।
শুধু তাই নয় এই অঞ্চলের জেনেটিক ল্যান্ডস্কেপের একটি ভালো নকশা বা চিত্র পাওয়া সম্ভব। এটি প্রাসঙ্গিক বিবাহপূর্ব জেনেটিক পরীক্ষার আরও উন্নতি সাধন করতে পারে।
এই গবেষণার ফলে শুধু কাতারে নয়, সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশও উপকৃত হতে পারে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের একজন জেনেটিসিস্ট বলেন, একই জনগোষ্ঠীর মানুষের বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা একটি ‘প্রকৃত’ গবেষণা।
অনেক সময় দেখা যায় যে, কিছু রোগ রয়েছে যেগুলোর উপস্থিতি রয়েছে এমন জায়গায় যেখানে নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হওয়া সাধারণ ব্যাপার। ফলে এ ধরনের অনুসন্ধান ও গবেষণা বিজ্ঞানীদের একত্রিত করতে সাহায্য করে যে কিভাবে জিনগুলো মানুষের স্বাস্থ্যের ফলাফলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়া একটি সাধারণ ব্যাপার, বিশেষ করে সুদানে। আরব বিশ্বের বাইরেও এই গবেষণা হতে পারে যেখানে নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হয়।
এই অঞ্চলের জিনোম সম্পর্কে আরও ভালো বোঝার ফলে নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে বিয়ে সব জায়গায় কিছুটা নিরাপদ হয়েও উঠতে পারে।