English

28 C
Dhaka
সোমবার, নভেম্বর ১৮, ২০২৪
- Advertisement -

জীবাণুর সঙ্গে লড়াই

- Advertisements -

 আকাশ আহমেদ: আমাদের পৃথিবীতে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন প্রজাতির অনুজীব রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, আমরা আসলে অণুজীব সাগরে ডুবে আছি। এই ১ ট্রিলিয়ন প্রজাতির অনুজীবের মধ্যে ১৪০০ প্রজাতি (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়া, ছত্রাক) মানুষকে সংক্রমণ করতে পারে যাদের আমরা প্যাথোজেন বা জীবাণু বলে থাকি।

অ্যান্টিবায়োটিক হচ্ছে ‘ম্যাজিক বুলেট’ বা ‘মিরাকল ড্রাগ’ যা আজ থেকে প্রায় ৯৬ বছর আগে স্যার আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং আবিষ্কার করেছিলেন (পেনিসিলিন)। পেনিসিলিনের জাদুকরী প্রভাবে চিকিৎসাশাস্ত্র ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী দেয়াল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত সৈনিকদের সুস্থতায় ব্যাপক সাড়া ফেলে।

Advertisements

বিজ্ঞানের অত্যাশ্চর্য সফলতায় এর পর একে একে আবিষ্কা হতে থাকে আরও নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে সেই আবিষ্কারকে পরাভূত করে ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে অ্যানন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া। শুধু ২০১৯ সালে সারা পৃথিবীতে প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ ছিল অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, যেখানে প্রত্যেক পাঁচটি মৃত্যু তালিকায় ছিল একটি শিশু।

২০১৪ সালে লন্ডনের একদল গবেষক অভিক্ষেপ করেন, ২০৫০ সালে পৃথিবীতে প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু সংক্রমণ যা এইডস, ক্যান্সার বা হৃৎপিণ্ডের জটিলতায় মৃত্যুর চেয়েও বেশি। কেন ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে যাচ্ছে– এই প্রশ্নের নির্ভুল বা একক কোনো কারণ না থাকলেও অনেকগুলো নিয়ামক রয়েছে যা এই পুরো প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। প্রথমত, অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর উত্থানের মূল কারণ।

প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য আমরা যেভাবে লড়াই করি, সংগ্রাম করি, ঠিক তেমনি ব্যাকটেরিয়াও অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতে আত্মরক্ষামূলক কিছু প্রচেষ্টা করতে থাকে। আমরা যখন অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করি কিংবা উপসর্গ কিছুটা উপশম হলে অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স শেষ না করেই বন্ধ করে দিই, তখনই ব্যাকটেরিয়ার কিছু অংশ এই টিকে থাকার লড়াইয়ে জিতে যায়; এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে অভিযোজিত হয়।

এই অভিযোজন বা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার উত্থান কেবল মানবদেহে নয় বরং প্রকৃতিতেও প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। হাসপাতাল বর্জ্য বা পোলট্রি খামার বা পশু পালনে ব্যবহার করা অ্যান্টিবায়োটিক যখন প্রকৃতিতে চলে আসে, তখন প্রকৃতিতে থাকা ব্যাকটেরিয়াও বিশেষ অভিযোজন বা আত্মরক্ষামূলক প্রচেষ্টায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, আধুনিক গবেষণা বলছে, কৃষিকাজে ব্যবহার করা সার, হরমোন এবং জীবাণুনাশক রাসায়নিক পদার্থের যে মিউটাজেনিক বা পরিব্যক্তি ঘটানোর ক্ষমতা রয়েছে, তা থেকেও পরিবেশে থাকা ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে যাচ্ছে।

তৃতীয়ত, কলকারখানা থেকে রং, ভারী ধাতু ও বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ যখন পরিবেশ দূষণ করছে ঠিক সেই সময়ে ব্যাকটেরিয়াও এই দূষণে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টায় নিজের পরিবর্তন আনছে। এই পরিবর্তনের নৈমিত্তিক ফলাফল হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার আত্মপ্রকাশ। বাংলাদেশ সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বিগত পাঁচ বছরে ব্যাকটেরিয়ার অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়েছে ১১ শতাংশ এবং বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের প্রায় ৮২ শতাংশ অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজি বিভাগের একটি গবেষণায় ২০২২ সালের  জানুয়ারী মাস থেকে আসা প্রায় ৭২ হাজার রোগীর নমুনা পরীক্ষা করে দেখা যায়, ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সালমোনেলা, ই-কোলাই, স্যুডোমোনাস, স্ট্যাফাইলোকক্কাস, ক্লেবশিয়েলা জাতীয় ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ করে থাকে, যাদের বিপরীতে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএইচও) করা অ্যাকসেস এবং ওয়াচ গ্রুপের প্রায় ৯০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর।

শুধু ঢাকা শহরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া নিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় একাধিক গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছে, যেখানে উঠে এসেছে কিছু ভীতিকর তথ্য। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার বাতাসে পাওয়া গেছে রোগ সৃষ্টিকারী স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস নামক ব্যাকটেরিয়া যার প্রায় ৮০ শতাংশ একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা নদীসহ শহরের হাতিরঝিল ও বিভিন্ন লেকের পানিতে পাওয়া গেছে ইকোলাই, ভিবরিয়ো কলেরির মতো অনেক ডায়রিয়াজনিত রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া, যার প্রায় ৯০ শতাংশ একাধিক গ্রুপ এবং ৫০ শতাংশ দুই বা ততোধিক গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী।

Advertisements

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি প্রোগ্রামের ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণায় দেখা যায় নিবিড় পর্যবেক্ষণ বা আইসিইউতে থাকা রোগীর সংক্রমণে যে অ্যাসিনিটোব্যাকটার, ক্লেবশিয়েলা ও স্যুডোমোনাস ব্যাকটেরিয়া দায়ী, তার প্রায় ৬০ শতাংশ দুই বা ততোধিক গ্রুপের পাঁচ থেকে সাতটি প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই প্রতিনিয়ত কঠিন হয়ে যাচ্ছে। একটি সাধারণ প্রস্রাব কিংবা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নির্মম মৃত্যুর কারণ হয়ে যাচ্ছে শুধু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার জন্য।

হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের দেখতে যাওয়া স্বজন হয়তো বুঝতেই পারছেন না রোগীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তিনি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়ে যাচ্ছেন কিংবা পরিবেশ থেকে ব্যাকটেরিয়া নিয়ে রোগীকে সংক্রমিত করছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং শল্যচিকিৎসায় বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব অর্জন এবং সাফল্য আমাদের গর্বিত করে, তা নিমেষেই ম্লান করে দিতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ।

তাই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর বিরুদ্ধে আমাদের একটি ডেটা ড্রাইভেন বা গবেষণালব্ধ সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের ক্রয়-বিক্রয়কে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএইচও) অ্যান্টিবায়োটিক স্টুয়ার্ডশিপ প্রোগ্রামের গাইডলাইন যথাযথ বাস্তবায়ন করার জন্য চিকিৎসক, অণুজীববিজ্ঞানী ও গবেষকদের একীভূত করে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে অ্যান্টিবায়োটিকের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

ব্যাকটেরিয়া যেসব অ্যান্টিবায়োটিকে প্রতিরোধী হয়ে গেছে, সেগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ রাখা যেতে পারে (অ্যান্টিবায়োটিক হলিডে)। কিছু অ্যান্টিবায়োটিক বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত রাখা যেতে পারে। সর্বোপরি, ল্যাবভিত্তিক পরীক্ষা আরও বাড়াতে হবে এবং ল্যাবের ফলাফল ব্যতীত অ্যান্টিবায়োটিকের এম্পেরিক্যাল ব্যবহারে সংযত হতে হবে। মনে রাখতে হবে, অ্যান্টিবায়োটিকের জাদুকরী ক্ষমতা যদি আমরা হারিয়ে ফেলি তাহলে আসন্ন সংক্রমণ মানবসভ্যতাকে বিপন্ন করে তুলবে; সে যুদ্ধে আমাদের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত।

[শিক্ষক এবং গবেষক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়]

Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন