জনপ্রিয় রক্ স্টার, গীতিকার-সুরকার, গীটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চুর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ । তিনি ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৬ বছর। প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট, চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নে, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ইশহাক চৌধুরী, মা নুরজাহান বেগম। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু । তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-এর অধীন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই তিনি বিভিন্ন রক্ ব্যান্ডের গান শুনতেন। সেখান থেকেই ব্যান্ডের প্রতি ও গীটার বাজানোর প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁর বাবা তাঁকে ১১তম জন্মদিনে একটি গীটার উপহার দেন। সেই থেকেই গীটার বাজানোর প্রতি তাঁর আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। তাঁকে গীটার শেখাতেন জেকব ডায়াজ নামের একজন বার্মিজ গীটার বাদক, যিনি তখন চট্টগ্রামে থাকতেন।
আইয়ুব বাচ্চু ১৯৭৬ সালে, চট্টগ্রামে কলেজ জীবনে ‘আগলি বয়েজ’ নামক ব্যান্ড গঠনের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গীত জীবনের সূচনা করেন। ১৯৭৭ সালপ ‘ফিলিংস’ (বর্তমানে নগর বাউল নামে পরিচিত)-এ যোগ দেন, এই ব্যান্ড দলের সাথে ১৯৮০ পর্যন্ত কাজ করেন। একই বছরে তিনি ‘সোলস্’-এর প্রধান গীটারবাদক হিসেবে কাজ করেন। সোলস্-এ ছিলেন ১৯৯০ সাল পর্যন্ত।
আইয়ুব বাচ্চু ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল, তাঁর নিজের ব্যান্ড ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’ গঠন করেন, যা পরবর্তীকালে ‘লাভ রান্স ব্লাইন্ড’ নামে বা সংক্ষেপে এল আর বি নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
একক কন্ঠশিল্পী হিসেবেও তিনি সফলতা পেয়েছেন। তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্ত গোলাপ’, যা ১৯৮৬-তে প্রকাশিত হয়। তাঁর সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় একক অ্যালবাম ছিল ‘কষ্ট’। ২০০৭ সালে, আইয়ুব বাচ্চু দেশের প্রথম বাদ্যযন্ত্রগত অ্যালবাম ‘সাউন্ড অফ সাইলেন্স’ প্রকাশ করেন। এল আর বি থেকে যেসব অ্যালবাম বেরিয়েছিল তারমধ্যে- সুখ, তবুও, ঘুমন্ত শহরে, স্বপ্ন, আমাদের বিস্ময় (ডাবল এলবাম), মন চাইলে মন পাবে, অচেনা জীবন, মনে আছে নাকি নাই, স্পর্শ, যুদ্ধ প্রভৃতি।
ব্যান্ডসঙ্গীতশিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা আইয়ুব বাচ্চু, চলচ্চিত্রেও গান গেয়েছেন এবং জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন। তিনি যেসব ছবিতে কন্ঠ দিয়েছেন তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য- আজকের বাদশা, লুটতরাজ, সাগরিকা, লাল বাদশা, আম্মাজান, গুন্ডা নাম্বার ওয়ান, ব্যাচেলর, রং নাম্বার, চাঁদের মত বউ, চোরাবালি, টেলিভিশন (ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ও দুটি গানে সুর), তেজী, মেয়েরাও মাস্তান, এক কাপ চা অন্যতম।
আইয়ুব বাচ্চুর জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- অনেক রাত্রি একা একা হাঁটছি.., অবাক হৃদয় নিয়ে থমকে আছি আমি…, অলস দুপুরে উঠোন জুড়ে…, আঁধারে ছিলাম এই আমি.., আকাশ কাঁদে বাতাস কাঁদে…, আমার একটা নির্ঘুম রাত…, আমার কোন সীমান্ত নেই…, আমি আজ বহুদিন পরে কাঁদলাম…, আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি.., আমি গানে গানে আসবো ফিরে…, আমি চৌদ্দপুরুষের ভুমিদাস…, আমি জানিনা তুমি কেমন আছ.., আমি তো প্রেমে পড়িনি প্রেম আমার উপরে পড়েছে…, আমি বারোমাস তোমায় ভালোবাসি…, আমি যাবো চলে দূরে বহুদূরে…, আর কেঁদো না মিছে মায়ায় জড়িয়ে…, আর বেশি কাঁদালে উড়াল দেব আকাশে.., সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে…, এই রুপালি গিটার ফেলে…, আম্মাজান আম্মাজান চোখের মণি আম্মাজান.., ফেরারি এই মনটা আমার…, অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে…, আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে…, আরো আগে কেন তুমি এলে না…, এই জগত সংসারে তুমি এমনই একজন…, তোমার আমার প্রেম এক জনমের নয়…, ভুলে গেছি জুতোটার ফিতেটাও বাঁধতে…, স্বামী আর স্ত্রী বানায় যেজন মিস্ত্রী…, ইত্যাদি।
গানের পাশাপাশি তিনি বেতার-টেলিভিশনের অনেক বিজ্ঞাপনে জিঙ্গেল করেছেন।
আইয়ুব বাচ্চু তাঁর গানের জন্য বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। যারমধ্যে- ছয়বার মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার (এল আর বি’র সাথে), সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস, বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার, টেলেসিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার-২০১৭ উল্লেখযোগ্য ।
ব্যক্তিজীবনে আইয়ুব বাচ্চু, ১৯৯১ সালের ৩১ জানুয়ারি, ফেরদৌস চন্দনা’কে বিয়ে করেন । তাদের দুটি সন্তান আছে। মেয়ে ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব এবং ছেলে আহনাফ তাজওযার আইয়ুব।
বাংলাদেশের একজন অন্যতম সেরা গীটারবাদক ও কিংবদন্তীতুল্য ব্যান্ডসংগীত তারকা ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু।
৯০-এর দশকে মাতিয়েছেন সঙ্গীতাঙ্গনের, অডিও ইন্ডাস্ট্রি আর কনসার্ট-এর মঞ্চ। পেয়েছেন তুমুল জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও তাঁর পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা ছিল।
আইয়ুব বাচ্চু’কে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে ১৮ ফুট উচ্চতার একটি গিটারের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। আইয়ুব বাচ্চুর একটি জনপ্রিয় গানের শিরোনাম অনুসারে এই ভাস্কর্যের নাম রাখা হয়- রূপালী গিটার।