অধ্যাপক ডা. ইমনুল ইসলাম: শিশুরা যত ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়, তার মধ্যে বাতজ্বর একটি। এতে গিরা ফুলে গিয়ে জ্বর আসে। শিশুটি এই জ্বর আসাটা বাতজ্বর নয়, বাতরোগ। বাতরোগে বড়দের মতো শিশুরাও আক্রান্ত হয়ে থাকে। সাধারণত ১৬ বছর বয়সের নিচের যে কোনো শিশুর হাত-পা কিংবা শরীরের অন্য কোনো গিরা ফোলা ও গিরাব্যথা ছয় সপ্তাহ ধরে চললে তাকে বলে বাতরোগ বা জুভেনাইল ইডিওপেথিক আর্থ্রাইটিস। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুস্পষ্ট কারণ জানা যায় না।
তবে গবেষণায় কিছু বিষয়ের কথা, যেমন-বংশগতির প্রভাব, পরিবেশগত প্রভাব, সংক্রমণজনিত অর্থাৎ ভাইরাসজনিত কারণে এ রোগের সূত্রপাত ঘটে থাকে বলে জানা যায়। এটি আসলে অটোইমিন ডিজঅর্ডার। ফলে দেহের প্রতিরোধ-ব্যবস্থার ভুলে সুস্থ কোষ ও কলাগুলো প্রতিরোধ-ব্যবস্থার আক্রমণের শিকার হয়ে উল্লিখিত রোগের সৃষ্টি করে। আমাদের দেশের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা যায়, প্রতিলাখ শিশুর মধ্যে ৬০ জন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
রোগের লক্ষণ : দীর্ঘমেয়াদি গিরা ফোলা, ব্যথা ও গিরায় শক্ত ভাব, বিশেষ করে সকালে আধাঘণ্টা থেকে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত থাকে। শিরায় ব্যথা থাকায় গিরাগুলোর নির্দিষ্ট কাজ, যেমন-হাঁটা-বসা, লেখা ও অন্যান্য কাজকর্ম করতে সমস্যা হয়। প্রধানত হাঁটু, গোড়ালি, কব্জি, কনুইয়ের বড় গিরা ও হাত-পায়ের পাতার ছোট গিরাগুলো আক্রান্ত হয়। এছাড়া তীব্র জ্বর, শরীরে লালচে দানা ছাড়াও যকৃৎ, প্লিহা, লসিকাগ্রন্থি বড় হয়ে যেতে দেখা যায়। চোখের সংক্রমণ কিছু ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে। রোগটির বিস্তৃতি এমন যে, কখনো আক্রান্ত শিশুর কোনো অভিযোগ থাকে না, অর্থাৎ শিশু ভালো থাকবে। আবার কখনো রোগের তীব্রতায় কাতর হবে। বাতরোগ ও বাতজ্বরের অনেক বিষয় একই রকমের মনে হলেও এ দুই রোগের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। বাতরোগে আক্রান্ত শিশুর সঠিক সময়ে চিকিৎসা প্রদান না করা হলে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক অক্ষমতা দেখা দিতে পারে। তাই সময়মতো রোগ নির্ণয় করে যথাযথ চিকিৎসা প্রদানের মধ্য দিয়ে আক্রান্ত শিশুর শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে উদ্বিগ্ন মা-বাবার ভার লাঘব করা যেতে পারে।
বাতরোগ ও বাতজ্বরের মধ্যে পার্থক্য : বাতরোগে ১৬ বছর বয়সের নিচের শিশুরা আক্রান্ত হয়। বাতজ্বরে আক্রান্ত হয় ৫ থেকে ১৫ বছরের শিশুরা। বাতরোগের উৎপত্তি হয় ধীরে ধীরে। কিন্তু বাতজ্বরে হঠাৎ করে করে আক্রান্ত হয়। বাতরোগে বড় ও ছোট গিরা প্রতিসমভাবে আক্রান্ত হয়। কিন্তু বাতজ্বরে শুধু বড় গিরাগুলো অপরতিসমভাবে আক্রান্ত হয়। বাতরোগে গিরাগুলোর বিকৃতি থাকলেও বাতজ্বরে তা থাকে না। বাতরোগে আক্রান্ত গিরার দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা দেখা দিলেও বাতজ্বরে পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাতরোগে মাংসপেশির শুকিয়ে যাওয়া ও দুর্বলতা থাকলেও বাতজ্বরে তা থাকে না। বাতরোগে গিরা ছাড়া অন্য স্থানে সংক্রমণ (চোখ, যকৃৎ, প্লিহা, সেরোসাইটিস) হতে পারে। কিন্তু বাতরোগে তা হয় না। বাতরোগে অ্যাসপিরিন চিকিৎসায় দ্রুত গিরা ফোলা ও ব্যথার উন্নতি দেখা যায় না। কিন্তু বাতজ্বরে নাটকীয়ভাবে গিরাব্যথা ও ফোলার উন্নতি দেখা যায়। বাতরোগে রোগের কারণ সুস্পষ্ট নয়। কিন্তু বাতজ্বরে গ্রুপ-এ বিটা হেমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাসের সঙ্গে শ্বাসনালি প্রদাহের সম্পর্ক রয়েছে।
লেখক : অধ্যাপক, শিশুরোগ বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা