বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর প্রধান আটটি কারণের ছয়টির সঙ্গেই তামাক জড়িত। ফুসফুসের ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর শতকরা ৯০ ভাগের জন্যই দায়ী তামাক। বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখ ৬১ হাজারেরও বেশি মানুষ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারজনিত রোগে মারা যান। তামাক ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক নিয়ে লিখেছেন বারডেম হাসপাতালের ডেন্টাল সার্জারি বিভাগের সাম্মানিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী
মাথার চুল থেকে পায়ের নখ ও আমাদের দেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তামাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যেমন—মাথার চুল পড়া, চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট, মুখের ক্যান্সার, গলার ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, পাকস্থলীর ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, যৌনশক্তি নাশ, গর্ভপাত, মৃত শিশুর জন্ম, পায়ের পচনশীল রোগ ইত্যাদি।
জর্দা খেলে মুখের ক্যান্সার নিশ্চিত
যাঁরা পানের সঙ্গে জর্দা খান এবং নিয়মিত অনেকবার পান খান তাঁদের মুখের ঘা বেশি হয়। অনেকেই তামাকপাতাকে হাতের মধ্যে নিয়ে চুনের সঙ্গে মিশিয়ে গালের মধ্যবর্তী স্থানে রাখেন, তাতে দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে ওই স্থানে ঘা হতে পারে।
শুধু ঘা নয়, পরবর্তী সময়ে এই ঘা ক্যান্সারেও রূপ নিতে পারে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যেখানে তামাকপাতা নেশার মতো ব্যবহৃত হয় সেসব অঞ্চলেও মুখের ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির তথ্যানুযায়ী এবং ডায়াবেটিক সমিতির বারডেম হাসপাতালে ডেন্টাল বিভাগের দুটি জরিপে দেখা যায় যে যাঁরা নিয়মিত ধূমপান করেন এবং তামাকপাতা ও জর্দা দিয়ে পান খান অথবা তামাকপাতা গালের মধ্যে রেখে ব্যবহার করেন তাঁদের মধ্যে মুখের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থাৎ যাঁরা জর্দা খান বা তামাকপাতা খান তাঁদের রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকি হতে পারে ৬০ ভাগ এবং যাঁরা ধূমপান করেন এবং সেই সঙ্গে তামাকপাতা ও পানের সঙ্গে ব্যবহার করেন তাঁদের ঝুঁকি শতকরা ৮০ ভাগ। সুতরাং যাঁদের মুখের ঘা রয়েছে এবং এসব অভ্যাস ছাড়তে পেরেছেন তাঁদের মুখের ঘা থেকে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা শতকরা ১০০ ভাগ নিশ্চিতভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। তবে মনে রাখবেন, যদি মুখের মধ্যে এসব ঘা চিকিৎসার পরও দুই থেকে তিন সপ্তাহ স্থায়ী হয়, তবে অবশ্যই বায়োপসি অথবা মাংসের টিস্যু পরীক্ষা করে দেখতে হবে। কারণ মুখের এসব ঘা বা সাদা ক্ষতগুলোকে বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন ‘প্রি-ক্যান্সার লিশন’ বা ‘ক্যান্সারের পূর্বাবস্থার ক্ষত’। যাঁরা ধূমপান করেন বা তামাকপাতা বা জর্দা-গুল ব্যবহার করেন তাঁরা অবশ্যই দাঁত ও মুখের যত্ন নেবেন এবং এসব ঘা দেখা দেওয়া মাত্রই চিকিৎসার ব্যবস্থা নেবেন।
মুখগহ্বরের ক্যান্সারের কারণ ধূমপান
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, যাঁরা তামাক ও পান-সুপারি চিবান এবং যাঁদের জর্দা ও খইনি খাওয়ার অভ্যাস তাঁদের মুখগহ্বরের ক্যান্সার বেশি হয়। বিলেত, আমেরিকায় মুখগহ্বরের ক্যান্সার হলো ২ থেকে ৩ শতাংশ (সর্বমোট ক্যান্সারের ২-৩ শতাংশ) অথচ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় এর পরিমাণ হলো ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশের অবস্থা প্রায় একই। বিজ্ঞানীরা বলেন, এর কারণ হলো তামাকের সঙ্গে সুপারির কুচি চিবানো। তামাক-জর্দা খাওয়া। যাঁরা ধূমপান করেন তাঁদেরই মুখে ক্যান্সার বেশি হয়। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, সিগার ও পাইপ খেলেও মুখের ক্যান্সার হয় খুব বেশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয় ঠোঁটের ক্যান্সার।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন সিগার ও পাইপ থেকে যে উচ্চমাত্রায় তাপ নির্গত হয়, তা মুখের কোষকলাকে উত্তেজিত করে এবং তামাক থেকে নির্গত উচ্চ তাপের সঙ্গে ঠোঁটের ক্যান্সারের সম্পর্ক তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন। যাঁরা মদ্যপ তাঁদেরও মুখের ক্যান্সার হয় বেশি। মদ্যপরা সাধারণত অতিরিক্ত ধূমপানও করেন এবং দুটো মানিক জোড়ের সমন্বিত ক্রিয়া ক্যান্সার ঘটানোর জন্য যথেষ্ট।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মুখগহ্বরের ক্যান্সার বাংলাদেশে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে বেশি হয়। পশ্চিমা দেশের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৪০ বছর বয়সের পর পুরুষদের এই ক্যান্সার বেশি হয় এবং মহিলাদের তুলনায় দ্বিগুণ।
মুখগহ্বরের ক্যান্সারের মধ্যে জিহ্বায় হয় ২০ শতাংশ, ঠোঁটে ১৫ শতাংশ এবং লালাগ্রন্থিতে ১০ শতাংশ। ২৫ শতাংশ হলো গলদেশের ক্যান্সার। এ ছাড়া মাড়ি, তালু, টনসিল, চোয়ালেও এই ক্যান্সার হয়।
মুখগহ্বরের বেশির ভাগ ক্যান্সারের উৎস উপবিষ্ট কোষ থেকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নাসিকা ও গলদেশের ক্যান্সার বেশি লক্ষ করা যায়। হংকং ও চীনে কিছু এলাকায় এর স্থানিক প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ক্যান্সার সর্বমোট মৃত্যুর হারের মাত্র ০.৫ থেকে ১ শতাংশ হলো নাসিকা ও গলদেশের ক্যান্সার অথচ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই পরিমাণ হলো ১৩ শতাংশ। এর পেছনে ভৌগোলিক, খাদ্যাভ্যাস, পরিবেশগত এবং পেশাগত কারণ রয়েছে বলে অনুমান করা যায়। মুখগহ্বরের ক্যান্সার কেন হয় এর সঠিক কারণ না জানা গেলেও বিজ্ঞানীরা তামাক ধূমপানকে উপাদান চিহ্নিত করেছেন, যা ক্যান্সার ঘটাতে পারে বলে তাঁদের ধারণা।
করোনাভাইরাসেরও ঝুঁকি বাড়ায় ধূমপান
করোনাভাইরাসের ঝুঁকি কমাতে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য সেবন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ জরুরি। বিশেষত ধূমপায়ী বা তামাক সেবনকারীদের করোনায় আক্রান্তের ঝুঁকি ১৪ গুণ বেশি! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর মধ্যে জানিয়েছে, সিগারেট সেবনে হাতের আঙুলগুলো ঠোঁটের সংস্পর্শে আসে এবং এর ফলে হাতে (সিগারেটের ফিল্টারে) লেগে থাকা ভাইরাস মুখে চলে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তা ছাড়া ধূমপায়ীদের ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যায় ও ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি, যা তাদের কভিড আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। ধূমপানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পায় বিধায় সহজেই ক্ষতিকর ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এমনকি অকালমৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে।
পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিকর দিক
ধূমপান ছাড়াও তামাকের আরো দুটি মারাত্মক ক্ষতিকর দিক রয়েছে, যার মধ্যে একটি হলো পরোক্ষ ধূমপান বা সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোকিং। যিনি ধূমপান করেন না, তিনি ধূমপায়ীর পাশে বসে থেকেও ধূমপানের ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বছরে ১২ লক্ষাধিক অধূমপায়ী পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, যার বেশির ভাগই শিশু ও নারী।
লক্ষণ দেখলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন
যখন লক্ষ্য করবেন মুখগহ্বরে একটি ক্ষত বা ঘা যা শুকাচ্ছে না এবং সহজেই এ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, খাদ্য গিলতে অসুবিধা হচ্ছে, সব সময় গলায় কোনো কিছুর উপস্থিতি অনুভূত হচ্ছে, তাহলে অবশ্যই অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন। এ রকম লক্ষণ হওয়া মানেই ক্যান্সার নয়, সাবধানতা হিসেবে ডাক্তার দেখানো উচিত। এ ব্যাপারে ডেন্টাল সার্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। যেমন—মুখগহ্বর রুটিন পরীক্ষার সময় অথবা অন্য সময় যখন দাঁত বা মুখগহ্বরের চিকিৎসা করছেন তখন তাঁদের দায়িত্ব হবে মুখগহ্বরের কোষকলায় কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন হচ্ছে কি না তা লক্ষ করা। সুতরাং কেউ যদি নিয়মিত ডেন্টাল সার্জন দিয়ে বছরে অন্তত একবার মুখের চেকআপ করান, তাহলে এ রকম কিছু ঘটে থাকলেও চিকিৎসক সূচনাকালেই একে শনাক্ত করতে পারেন।
প্রতিরোধ
মুখের ভেতরের ক্যান্সার প্রতিরোধে তামাক সেবন অর্থাৎ সিগারেট, বিড়ি, হুঁকা, দোক্তা, কিমা, খইনি, গুল, নস্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, যদি আমরা তামাক, ধূমপান, জর্দা ইত্যাদি বর্জন করতে পারি, তাহলে মুখের ক্যান্সার, গলার ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সারসহ অনেক ক্যান্সার রোগকেই প্রতিরোধ করতে পারব।