ফুটবল বিশ্বকাপের গত ২১ আসরে যা ঘটেনি এবার তা-ই দেখবে পুরো বিশ্ব। প্রথমবারের মতো বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চে দেখা যাবে নারী রেফারি। বিশ্ব ফুটবলে নারীদের অগ্রযাত্রায় যা নতুন এক দিগন্ত। ছেলেদের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো নারী রেফারিরা ম্যাচ পরিচালনা করবেন।
বিশ্বকাপের ৩৬ জনের রেফারি প্যানেলে জায়গায় করে নিয়েছেন তিন নারী রেফারি। তাঁরা হলেন ফ্রান্সের স্তেফানি ফ্রাপার্ত, জাপানের ইউশিমি ইয়ামাশিতা এবং রুয়ান্ডার সালিমা মুকানসাঙ্গা। নিজ নিজ দেশে ছেলেদের শীর্ষ ফুটবল লিগ ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ম্যাচ পরিচালনার মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে এসেছেন তাঁরা।
স্তেফানি ফ্রাপার্ত
ফ্রান্স ফুটবলের মেয়েদের লিগে রেফারি হিসেবে পথচলা শুরু স্তেফানি ফ্রাপার্তের। ২০১১ সালে প্রথম নারী রেফারি হিসেবে ফ্রেঞ্চ ফুটবলের পুরুষদের তৃতীয় বিভাগ লিগে ম্যাচ পরিচালনা করেন তিনি। এরপর ছেলেদের দ্বিতীয় বিভাগ এবং ২০১৯ সালে ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ানে ম্যাচ পরিচালনা করে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লেখান ফ্রাপার্ত। মাঝে ২০১৫ ও ২০১৯ নারী বিশ্বকাপের অন্যতম রেফারি ছিলেন তিনি। প্রথম কোনো নারী রেফারি হিসেবে ২০১৯ সালে উয়েফা সুপার কাপের ফাইনালে লিভারপুল ও চেলসির মধ্যকার ম্যাচের দায়িত্বে ছিলেন ফ্রাপার্ত। এর পরেই তাঁর ক্যারিয়ার নতুন এক মোড় নেয়। ২০২০ সালে পুরুষদের চ্যাম্পিয়নস লিগ ও গত বছর পুরুষদের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে লেদারল্যান্ডস ও লাটভিয়ার মধ্যকার ম্যাচে বাঁশি বাজান তিনি। সর্বশেষ গত ২ অক্টোবর চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদ ও সেল্টিকের মধ্যকার ম্যাচেও রেফারি ছিলেন তিনি। নিয়মিত ছেলেদের ম্যাচ দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করায় পুরস্কার হিসেবে সুযোগ এসেছে বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে। কাতার বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়ে ফ্রাপার্ত বলেছেন, ‘আপনি নারী নাকি পুরুষ, সেটা তেমন জরুরি নয়। কাজের ক্ষেত্রে আপনার সক্ষমতা আছে কি না, সেটা বেশি জরুরি। ’ বিশ্বকাপের মতো আসরে নারী রেফারিদের সংযোজনে ফিফাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ৩৮ বছর বয়সী এই নারী রেফারি, ‘কাতারের মতো দেশে যেখানে নারী অধিকারের রেকর্ড ভালো নয়, সেখানে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে নারী রেফারি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিফা একটি শক্ত বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ফুটবলবিশ্বের সর্বোচ্চ সংস্থাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ’
ইউশিমি ইয়ামাশিতা
রেফারি হতে না চাওয়া মেয়েই কিনা এবারের কাতার বিশ্বকাপে ম্যাচ পরিচালনা করার গুরু দায়িত্ব পেয়েছেন! একসময় খণ্ডকালীন ফিটনেস ট্রেনার হিসেবে কাজ করতেন ইউশিমি ইয়ামাশিতা। সেই চাকরি ছেড়ে রেফারিংয়ে নাম লেখান তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ম্যাচ পরিচালনার জন্য এক বন্ধু তাঁকে এক রকম জোর করে ধরে নিয়ে মাঠে নামিয়ে দেয়। এরপর থেকেই রেফারি হিসেবে কাজ করার আনন্দ পেয়ে যান ইয়ামাশিতা। ২০১৯ সালে প্রথম নারী রেফারি হিসেবে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নস লিগের একটি ম্যাচ পরিচালনা করেন তিনি। জাপানের পুরুষ ফুটবলের সর্বোচ্চ লিগেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এর ফলেই বিশ্বকাপে ম্যাচ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এই উত্তরণের প্রতিক্রিয়ায় ইয়ামাশিতা মজার ছলে বলেছেন, ‘আমি কখনোই রেফারি হতে চাইনি। আমি মনে করতাম, রেফারিরা শুধু কালো পোশাক পরে!’ ৩৬ বছর বয়সী এই নারী রেফারির বিশ্বাস, ফুটবল মাঠে নারী রেফারিরাও পুরুষদের মতো বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছেন, ‘যদি আমার সহকর্মীরা আস্থা অর্জন করতে না পারত তাহলে আমি বিশ্বকাপে যেতে পারতাম না। ’
সালিমা মুকানসাঙ্গা
এ বছরের শুরুতেই ইতিহাস গড়েন রুয়ান্ডার সালিমা মুকানসাঙ্গা। পুরুষদের আফ্রিকান নেশনস কাপে প্রথমবারের মতো নারী রেফারি হিসেবে ম্যাচ পরিচালনা করেন তিনি। এর পরেই সুযোগ আসে ছেলেদের বিশ্বকাপের বড় মঞ্চে। কিন্তু এমন সুযোগের আশা কখনোই করেননি মুকানসাঙ্গা, ‘এই সুযোগ পেয়ে আমি খুবই গর্বিত; কিন্তু কখনোই আমার স্বপ্ন ছিল না ছেলেদের ম্যাচ পরিচালনা করার। আমি সব সময় ভাবতাম মেয়েদের শীর্ষ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করব। ’ কাতার বিশ্বকাপের পর মুকানসাঙ্গার স্বপ্ন ২০২৩ নারী বিশ্বকাপের রেফারি প্যানেলে জায়গা করে নেওয়া।
ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আসক্তি ছিল সালিমার। নিজ এলাকার মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদের দলেও ফুটবল খেলতেন তিনি। সেখান থেকে রেফারি হওয়ার বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর। একসময় বাস্কেটবল খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি; কিন্তু রুয়ান্ডায় বাস্কেটবলে তেমন সুযোগ-সুবিধা না থাকায় পরবর্তী সময়ে রেফারিংয়ে মনোযোগ দেন। রেফারি কোর্স করে ২০ বছর বয়স থেকেই রুয়ান্ডার বিভিন্ন লিগে ম্যাচ পরিচালনা করতে থাকেন ৩৩ বছর বয়সী এই নারী। এভাবেই ধাপে ধাপে এগিয়ে এখন ছেলেদের বিশ্বকাপের মঞ্চে মুকানসাঙ্গা।