শেষ ষোলের খেলা শেষ। এবার কোয়ার্টার ফাইনাল মানে শেষ আটের পালা। সেই রাউন্ডেই সেমিফাইনাল মানে শেষ চারের টিকেট নিশ্চিত করতে হবে।
আর সেমির টিকেট পেতে শুক্রবার মাঠে নামছে শিরোপার অন্যতম দাবিদার দল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া, আর্জেন্টিনার নেদারল্যান্ডস। এ যেন লাতিন আমেরিকা আর ইউরোপের জমজমাট লড়াই দেখার অপেক্ষা।
শেষ চারের টিকেট পাওয়ার দাবিদার কারা?
ব্রাজিল
গ্রুপ পর্বে প্রথম দুই ম্যাচই জিতে নক-আউট নিশ্চিত করেছিল সেলেসাওরা। শেষ ম্যাচে বেঞ্চের খেলোয়াড়দের সুযোগ দেন ব্রাজিল কোচ তিতে, যদিও ক্যামেরুনের কাছে ১-০ গোলের ব্যবধানে হেরে যায় তারা।
গ্রুপ পর্বে ব্রাজিলের ফলাফল: ব্রাজিল ২-০ সার্বিয়া। ব্রাজিল ১-০ সুইজারল্যান্ড। ব্রাজিল ০-১ ক্যামেরুন। শেষ ষোলো: ব্রাজিল ৪-১ দক্ষিণ কোরিয়া
বিশ্বকাপে ১৬ বার কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে ব্রাজিল। যার মধ্যে ১১ বারই শেষ চারে পৌঁছায় সেলেসাওরা। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষেও তাদের হারের রেকর্ড নেই, তাই তারাই ফেভারিট হিসেবেই নামবেন।
শক্তির বিচারে সব পজিশনেই দুর্দান্ত সব খেলোয়াড় দিয়ে পূর্ণ তিতের দল। চোটের কারণে গ্রুপ পর্বের শেষ দুই ম্যাচ খেলতে পারেননি নেইমার। শেষ ষোলোর ম্যাচে ফিরেই দেখিয়েছেন কেন তিনি ব্রাজিলের সবথেকে বড় ভরসার জায়গা। দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে মন মাতানো ফুটবল খেলেছে জোগো বনিতোর বাহকেরা।
আর্জেন্টিনা
লাতিন আমেরিকার আরেক দল লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হেরেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই নক-আউট পর্বে উঠেছে আলবিসেলেস্তেরা।
গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনার ফলাফল: সৌদি আরব ২-১ আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনা ২-০ মেক্সিকো। আর্জেন্টিনা ২-০ পোল্যান্ড। শেষ ষোলো: আর্জেন্টিনা ২-১ অস্ট্রেলিয়া।
বিশ্বকাপে ৮ বার কোয়ার্টার-ফাইনালে উঠেছে আর্জেন্টিনা। যার মধ্যে ৫ বার শেষ চারে উত্তীর্ণ হয় আকাশি-সাদার দল। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে শেষ আটের ম্যাচে নামার আগে আত্মবিশ্বাসী লিওনেল মেসির দল।
সৌদি আরবের বিপক্ষে হারের পর লিওনেল স্কালোনির দলের রসায়ন নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন জেগেছিল। খেলোয়াড়রা সৌদি আরবকে হালকাভাবে নিয়েছেন কিনা সেই ব্যাপারেও কথা শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু পরের দুই ম্যাচে নিজেদের আসল রূপে ফেরে আলবিসেলেস্তেরা। বিশেষ করে পোল্যান্ডের বিপক্ষে নিজেদের ছন্দময় ফুটবল দেখায় আর্জেন্টিনা। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও শেষের কিছু সময় ব্যতিত বেশ চোখ জুড়ানো ফুটবলই দেখা গেছে মেসিদের পা থেকে।
নেদারল্যান্ডস
২০১৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কাছে টাইব্রেকারে হেরে সেমি-ফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়ার পর ২০১৮ বিশ্বকাপে সুযোগ পায়নি ডাচরা। তবে এবার সুযোগ পেয়ে তারা বুঝিয়ে দিয়েছে, বিশ্বকাপে কেন তাদের সমীহ করা উচিত।
‘এ’ গ্রুপ থেকে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেষ ষোলোয় এসেছে ডাচরা।
গ্রুপ পর্বে নেদারল্যান্ডসের ফলাফল: নেদারল্যান্ডস ২-০ সেনেগাল। নেদারল্যান্ডস ১-১ ইকুয়েডর। নেদারল্যান্ডস ২ -০ কাতার। শেষ ষোলো: নেদারল্যান্ডস ৩-১ যুক্তরাষ্ট্র।
এখন পর্যন্ত ৬ বার বিশ্বকাপের শেষ আটে উঠেছে ডাচরা, যার মধ্যে ৫ বারই শেষ চারে পৌঁছায় টোটাল ফুটবলের জনকরা।
ডাচদের বড় শক্তির জায়গা তাদের রক্ষণভাগ। লিভারপুল ডিফেন্ডার এবং দলের অধিনায়ক ভার্জিল ভ্যান ডাইক অনেকের মতেই বিশ্বসেরা ডিফেন্ডার। এছাড়াও আছেন ম্যাথিস ডি লিট, নাথান একের মতো ডিফেন্ডাররা। গ্রুপ পর্বে মাত্র একটি গোলই হজম করেছে লুই ফন হালের দল। শেষ ষোলোতেও তাদের রক্ষণ বেশ ভালোই সামলেছে যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণ। ডাচ রক্ষণ ভাঙতে লিওনেল মেসিদের বেশ বেগই পেতে হবে।
ফ্রান্স
বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা শেষ আটে উঠেছে বেশ হেসেখেলেই। গ্রুপ পর্বের প্রথম দুই ম্যাচ জিতে শেষ ষোলো নিশ্চিত করে ফেলার পর বেঞ্চের খেলোয়াড়দের নিয়ে শেষ ম্যাচে তিউনিশিয়ার কাছে হারলেও সেটি মোটেও প্রভাব ফেলতে পারেনি। শেষ ষোলোর ম্যাচে পোল্যান্ডকে উড়িয়ে দিয়ে কোয়ার্টার-ফাইনাল নিশ্চিত করে লে ব্লুজরা।
গ্রুপ পর্বে ফ্রান্সের ফলাফল: ফ্রান্স ৪-১ অস্ট্রেলিয়া। ফ্রান্স ২-১ ডেনমার্ক। ফ্রান্স ০-১ তিউনিশিয়া। শেষ ষোলো: ফ্রান্স ৩-১ পোল্যান্ড।
বিশ্বকাপে ৮ বার শেষ আটে উঠেছে ফ্রান্স, যার মধ্যে ৬ টিতেই জিতেছে তারা।
প্রতিটি জায়গাতেই ফ্রান্সের যথেষ্ট গোলাবারুদ মজুদ রয়েছে। আছেন একজন কিলিয়ান এমবাপ্পে, কাতার বিশ্বকাপের সব আলো এখন পর্যন্ত নিজের দিকে টেনে নিয়েছেন ২৩ বছর বয়সী ফ্রেঞ্চ ফরোয়ার্ড। ৫ গোল করে গোল্ডেন বুট জেতার লড়াইয়েও অন্যদের থেকে এগিয়ে এমবাপ্পে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও তিনি জ্বলে উঠলে ফ্রান্সের শেষ চারে যাওয়ার রাস্তা অনেকটাই সহজ হবে।
ক্রোয়েশিয়া
কাতার বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত অপরাজিত গত বিশ্বকাপের রানার্স-আপরা। নিজেদের ইতিহাসে এবারই প্রথম পরপর দুই বিশ্বকাপের শেষ আটে উঠেছে ক্রোয়াটরা। গ্রুপ পর্বে এক জয় দুই ড্র নিয়ে অপরাজিত থেকে গ্রুপ রানার্স-আপ হয়ে শেষ ষোলোয় উঠে লুকা মদ্রিচের দল। সেখানে জাপানকে টাইব্রেকারে হারিয়ে কোয়ার্টার-ফাইনাল নিশ্চিত করে তারা।
গ্রুপ পর্বে ক্রোয়েশিয়ার ফলাফল: ক্রোয়েশিয়া ০-০ মরক্কো। ক্রোয়েশিয়া ৪-১ কানাডা। ক্রোয়েশিয়া ০-০ বেলজিয়াম। শেষ ষোলো: ক্রোয়েশিয়া ০-০ জাপান (টাইব্রেকারে ৩-১ গোলে জয়ী ক্রোয়েশিয়া)।
এই নিয়ে তৃতীয় বারের মতো শেষ আটে উঠল ক্রোয়েশিয়া। আগের দুইবারই এই বাধা পেরিয়েছে তারা। তবে এবার প্রতিপক্ষ ব্রাজিল, সেলেসাওদের টপকে শেষ চারে যাওয়াটা বেশ কঠিনই হবে ক্রোয়াটদের জন্য।
ক্রোয়াটদের মূল শক্তি তাদের হার না মানা মানসিকতা। রাশিয়া বিশ্বকাপেও এই মানসিকতার উপর ভর করেই ফাইনালে উঠেছিল তারা। কাতারেও সেটির প্রমাণ দেখিয়েছে দলটি।
ইংল্যান্ড
১৯৬৬ বিশ্বকাপ জেতার পর আর ফাইনালে উঠতে পারেনি ইংলিশরা। তবে এবার সেই খরা কাটাতে বদ্ধ পরিকর গ্যারেথ সাউথগেটের শিষ্যরা। গ্রুপ পর্বে দুর্দান্ত খেলে শেষ ষোলো নিশ্চিত করে ইংল্যান্ড। সেখানে তাদের কাছে পাত্তা পায়নি সেনেগাল।
গ্রুপ পর্বে ইংল্যান্ডের ফলাফল: ইংল্যান্ড ৬-২ ইরান। ইংল্যান্ড ০–০ যুক্তরাষ্ট্র। ইংল্যান্ড ৩-০ ওয়েলস। শেষ ষোলো: ইংল্যান্ড ৩-০ সেনেগাল।
এবার নিয়ে ৮ বার শেষ আটে উঠেছে ইংল্যান্ড, যার মধ্যে ৩ বার শেষ চারে যেতে পেরেছে তারা। সাফল্যের থেকে ব্যর্থতার পাল্লাটাই ভারী ইংলিশদের।
এবারের বিশ্বকাপে দল হিসেবে সর্বোচ্চ গোল করেছে ইংল্যান্ডই, তাদের ১২ টি গোলে করেছেন ৮ জন ভিন্ন খেলোয়াড়। ইংল্যান্ডের রক্ষণকে ফাঁকি দিয়ে গোল করাটাও খুব সহজ নয়, ৪ ম্যাচে মাত্র ২টি গোল খেয়েছে ইংলিশরা।
পর্তুগাল
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপে স্বপ্নের ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরা থেকে আর মাত্র ৩ ধাপ দূরে তিনি এবং পর্তুগাল। যদিও পর্তুগালের শেষ আটে ওঠার পেছনে রোনালদোর মাঠের অবদান সামান্যই। গ্রুপ পর্বে প্রথম দুই ম্যাচ জিতে শেষ ম্যাচ দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে হারলেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হতে বেগ পেতে হয়নি পর্তুগালের। শেষ ষোলোতে কাতার বিশ্বকাপে নিজেদের সবথেকে বড় জয় পেয়েছে ফার্নান্দো সান্তোসের শিষ্যরা।
গ্রুপ পর্বে পর্তুগালের ফলাফল: পর্তুগাল ৩-২ ঘানা। পর্তুগাল ২-০ উরুগুয়ে। পর্তুগাল ১-২ দক্ষিণ কোরিয়া। শেষ ষোলো: পর্তুগাল ৬-১ সুইজারল্যান্ড।
এবারসহ মাত্র ৩ বার বিশ্বকাপে শেষ আটে উঠেছে পর্তুগিজরা। আগের দুইবারই এই পর্বের বাধা পেরিয়ে সেমি-ফাইনাল খেলেছে তারা। উজ্জীবিত মরক্কোর বিপক্ষে জিতলে স্বপ্নের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোরা।
বিশ্বকাপে আসার আগে দলের সবথেকে বড় শক্তির জায়গা ভাবা হচ্ছিল ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে। কিন্তু কাতারে রোনালদোর সাহায্য ছাড়াই দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে পর্তুগাল। তাদের করা ১২ গোলের মধ্যে কেবল একটি গোল করেছেন রোনালদো, সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ষোলোতে তার বদলে শুরুর একাদশে নামা গনসালো রামোস করেছেন হ্যাটট্রিক! মরক্কোর সামনে তাই পর্তুগিজ আক্রমণ সামলানোই সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ।
মরক্কো
কাতার বিশ্বকাপের সবথেকে বড় চমক মরক্কো, আফ্রিকা এবং আরবের আশা-ভরসার নাম এখন মরক্কো। বিশ্বকাপ শুরুর আগে অ্যাটলাসের সিংহদের সেভাবে হিসাবে না ধরলেও নিজেদের পারফম্যান্স দিয়ে সেটি আদায় করে নিয়েছে মরক্কো। বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া, কানাডার গ্রুপ থেকে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেষ ষোলোয় উঠে মরক্কো, সেখানে ফেভারিট স্পেনকে টাইব্রেকারে হারিয়ে শেষ আটে উঠে তারা। যেটি তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের শেষ আটে উঠা।
গ্রুপ পর্বে মরক্কোর ফলাফল: মরক্কো ০-০ ক্রোয়েশিয়া। মরক্কো ২-০ বেলজিয়াম। মরক্কো ২-১ কানাডা।
শেষ ষোলো: মরক্কো ০-০ স্পেন (টাইব্রেকারে ৩-০ তে জয়ী মরক্কো)।
এর আগে কখনো বিশ্বকাপের শেষ আটে উঠেনি মরক্কো, এটিই তাদের প্রথমবার।
দুর্দান্ত রক্ষণের পাশাপাশি গতিশীল প্রতি-আক্রমণ মরক্কোর সবথেকে বড় শক্তি। কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে উঠা দলগুলোর মধ্যে ক্রোয়েশিয়ার পাশাপাশি সবথেকে কম গোল খেয়েছে মরক্কোই, ৪ ম্যাচে মাত্র ১ বার তাদের জালে বল ঢুকেছে।