‘নওরোজ’ ইরানি সংস্কৃতির সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসবের নাম। ইরানি জনগণ অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করেন এ উৎসবটি। ফারসি ‘নওরোজ’ শব্দটির অর্থ নতুন দিন। ফারসি নতুন বছরের প্রথম দিনকে বলা হয় নওরোজ। এটি ঋতুরাজ বসন্তেরও প্রথম দিন। অর্থাৎ বসন্তের আগমনের মধ্য দিয়েই শুরু হয় দেশটির নতুন বছর।
আর বর্ষবরণের উৎসব পৃথিবীর সব দেশেই পালিত হলেও ইরানি নববর্ষের উৎসব অন্য যে কোনো নববর্ষের উৎসবের চেয়ে আলাদা। কারণ বাংলা নববর্ষ থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের নববর্ষের উৎসব যত আনন্দময় ও জাঁকজমকপূর্ণভাবেই পালিত হোক না কেন, তা নববর্ষের প্রথম দিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে একমাত্র ফারসি নববর্ষই দীর্ঘ সময়জুড়ে পালিত হয়ে থাকে। কারণ নওরোজ বা নববর্ষ ইরানি জাতির সবচেয়ে বড় উৎসব। তবে এ উৎসব কেবল ইরানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বিস্তৃতি হয়েছে।
ইন্দো-পারস্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাবে এটি ইরানের বাইরে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দেশেও মোগল আমলে নওরোজ উৎসবের প্রচলন শুরু হয়। মোগল শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় তখন বেশ ঘটা করে নওরোজ উৎসব পালিত হতো। ২০০১ সালে জাতিসংঘে বসন্তের প্রথম দিন ২১ মার্চ বিশ্ব নওরোজ দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং ২০০৯ সালে এটি মানবতার সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক নিদর্শন হিসাবে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
ইরানিরা নববর্ষের প্রথম দিন থেকে ১৩ দিন পর্যন্ত এ উৎসব পালন করে থাকে। রাষ্ট্রীয়ভাবেও এ উৎসবের জন্য দেশটিতে অন্য যে কোনো উৎসবের চেয়ে বেশিদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। এ উৎসব উপলক্ষ্যে দেশটির স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছুটি থাকে প্রায় দীর্ঘ এক মাস। ফারসি নতুন বছর শুরু হয় বসন্তের সূচনার মধ্য দিয়ে। বসন্তে প্রকৃতি যেমন নতুন করে সাজে, গাছে গাছে পুরোনো পাতা ঝড়ে নতুন পাতা গজাতে থাকে, ফুলে ফুলে মুখরিত হতে থাকে চারদিক, পাখির কণ্ঠ থেকেও যখন ভেসে আসে গানের সুর, তখন প্রকৃতি আর ইরানি জাতি বসন্ত ও নতুন বছরের আনন্দে একাকার হয়ে যায়।
নওরোজের আগেই ইরানিরা ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে তারা পাড়া-পড়শি ও আপনজনদের সহায়তা করেন। ঈদ বা নওরোজের অনেক আগেই পুরোনো আসবাবপত্র বা জরাজীর্ণ জিনিস ফেলে দিয়ে তারা নতুন জিনিস কেনেন। নতুন জামা-কাপড়, জুতা ইত্যাদি কেনার হিড়িক পড়ে যায়। নওরোজের মেহমানদারির জন্য তারা ব্যাপক পরিমাণ ফল, মিষ্টি ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী কিনে থাকেন। এ সময় স্থায়ী বাজার ছাড়াও অনেক অস্থায়ী বাজার বা মেলার আসর জমজমাট হয়ে ওঠে।
ইরানি জাতির নওরোজ বা ফারসি নববর্ষের উৎসব পালনের ইতিহাস অনেক প্রাচীন হলেও ইসলামের আবির্ভাবের পর ইরানে নওরোজ উৎসবের রীতিতে পরিবর্তন দেখা দেয়। ইসলামী আচার-অনুষ্ঠান যুক্ত হয় এ উৎসবের সঙ্গে। বিশেষ দোয়া পাঠের মধ্য দিয়ে ইরানি মুসলমানরা নওরোজ বা নববর্ষ শুরু করেন। এ মোনাজাতে তারা বলেন, ‘হে অন্তর ও দৃষ্টির পরিবর্তনকারী এবং দিন ও রাতের পরিচালনাকারী এবং অবস্থার পরিবর্তনকারী (মহান আল্লাহ), আমাদের অবস্থাকে সর্বোত্তম অবস্থায় রূপান্তরিত করুন।’ নওরোজের প্রথম সেকেন্ডেই সবাই এ দোয়া পাঠ করেন। এ সময় তাদের সামনে টেবিলে বা দস্তরখানে থাকে পবিত্র কুরআন, তসবিহ এবং ‘হাফতসিন’ নামে খ্যাত সাতটি বিশেষ সামগ্রীসহ আরও কিছু সামগ্রী।
‘হাফতসিন’ অর্থাৎ সাতটি ‘সিন’। ওই সাতটি জিনিসের নামের প্রথম অক্ষর ফারসি বা আরবি বর্ণমালার ‘সিন’ অক্ষর দিয়ে শুরু হওয়ায় সেগুলোকে এ নাম দেওয়া হয়েছে। এ সাতটি সামগ্রী হলো-‘সাবজে’ বা গম বা ডালের সবুজ চারা, সামানু বা গমের চারা দিয়ে তৈরি করা খাবার, সিব বা আপেল, ‘সেনজেদ’ নামের একটি বিশেষ ফল, ‘সোমাক্ব’ নামক বিশেষ মসলা, সির বা রসুন এবং সের্কে বা সিরকা। এসব সামগ্রী হলো নব-জীবন, প্রবৃদ্ধি, ফলবান হওয়া, প্রাচুর্য, সৌন্দর্য, সুস্থতা, ভালোবাসা, আনন্দ, ধৈর্য ইত্যাদির প্রতীক। এছাড়াও নওরোজের দস্তরখানে ডিম, আয়না, পানি, লাল রঙের ছোট মাছ ও ধাতব মুদ্রা রাখা হয়। এ সবকিছুরই রয়েছে বিশেষ অর্থ।
ইরানিরা নওরোজের দিন বাবা-মাসহ নিকটাত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় বেশ কয়েকদিন সরকারি ছুটি থাকায় ইরানিরা দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে সফর করেন এবং কেউ কেউ আবার দেশের বাইরেও বেড়াতে যান। অনেক ইরানি নওরোজের প্রথম প্রহর বা প্রথম দিনটি পবিত্র কোনো স্থানে কাটাতে পছন্দ করেন।
ফারসি প্রথম মাস বা ফারভারদিন মাসের ১ তারিখ থেকে শুরু হয় নওরোজ উৎসব এবং শেষ হয় ১৩ তারিখে। ১৩ তারিখে ইরানিরা কেউ-ই ঘরে থাকেন না। তারা সেদিন ঘরের বাইরে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও মনোরম প্রাকৃতিক স্পটে সময় কাটান। বিশেষ করে উদ্যান, ঝর্ণা, পাহাড়, পার্ক-এসব স্থানে তারা চাদর বিছিয়ে বা তাঁবু খাটিয়ে খোশগল্প করে এবং মজাদার খাবার খেয়ে সময় কাটান।
যে কোনো ঈদ বা উৎসব মানবীয় আনন্দের অপার উৎস। মানুষ আনন্দ-উৎসব ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। তবে আল্লাহর স্মরণ মানুষকে জোগায় সবচেয়ে বড় প্রশান্তি এবং অপার মানসিক সুখ। নওরোজ উপলক্ষ্যে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় ঈদের আনন্দকে ভাগ করে নেওয়ার জন্য অনেক ইরানি বিশেষ ত্রাণ তহবিলে অর্থ বা নানা জিনিসপত্র দান করে থাকেন। এসব অর্থ বা জিনিস গরিব, এতিম ও অভাবগ্রস্তদের দান করা হয়।