মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ, ক্ষমা ও মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে পবিত্র রমজান মাস। তাই রমজানের চাঁদ দেখে খুশি হয় মুমিনরা। ইসলামের সূচনাকাল থেকেই মুসলিমরা নানাভাবে রমজানের চাঁদ দেখে আনন্দ প্রকাশ করে আসছে। এতে যেমন আছে কিছু অভিন্ন বিষয়, তেমনি দেশে ও অঞ্চলভেদে কিছুটা পার্থক্যও দেখা যায়।
লেবানন : আরব দেশগুলোর ভেতর লেবাননে চাঁদ দেখা ও রমজানকে স্বাগত জানানোর বিশেষ ঐতিহ্য আছে। যে রাতে রমজানের চাঁদ দেখা যায় লেবানিজরা তাকে ‘সিবানা’। সিবানা শব্দটি মূলত ছিল ইস্তিবানা। যার অর্থ প্রকাশ পাওয়া। এর দ্বারা রমজানের চাঁদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়। এই রাতে এশার নামাজের পর পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা মিলে সমুদ্রসৈকতে যায় এবং বিশেষ খাবার গ্রহণ করে। দীর্ঘ রাত পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করে। বিদায়ের সময় তারা বলে, ‘পানাহার ও ভোগ-বিলাসকে বিদায়। আগামীকাল হোক আল্লাহর অনুতপ্তের। ’
মিসর : মিসরের দারুল ইফতা থেকে চাঁদ দেখার ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাঘাটে সর্বাত্মক উৎসব শুরু হয়। সংসারের দায়িত্বশীলরা রমজানের প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে দোকানে ভিড় করে এবং শিশুরা লণ্ঠন হাতে রাস্তায় নেমে আসে। তারা দলবেঁধে ঘুরতে থাকে এবং ঐতিহ্যবাহী মিসরীয় গানগুলো গাইতে থাকে। রমজানে মিসরের রাস্তাগুলো রঙিন লণ্ঠন ও কাগজ দিয়ে সাজানো হয়। বাড়ি-ঘর ও ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোতে মিসরের বিখ্যাত কারিদের তিলাওয়াতের রেকর্ড বাজানো হয়।
তুরস্ক : তুর্কিরা বাড়ির ছাদে, পাহাড়ের টিলা ও গ্রামের শেষ প্রান্তে একত্র হয়ে রমজানের চাঁদ দেখে। চাঁদ দেখার রাষ্ট্রীয় ঘোষণা আসার পর প্রতিটি বাড়িতে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। বিশেষত ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলোতে। এই আনন্দে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে বয়স্করাও যুক্ত হয়। ঘরগুলো মিস্ক, আম্বর ও গোলাপ জলের ঘ্রাণে ম ম করে। বাড়ির দরজা ও আঙিনাগুলোতেও সুগন্ধি ছিটানো হয়। রমজানে মসজিদ আলোকসজ্জা করা তুর্কি ঐতিহ্যের অংশ। তুর্কিরা এটাকে ‘মাহয়া’ বা পুনর্জীবন বলে থাকে।
ফিলিস্তিন : রমজানের চাঁদ দেখার পর ফিলিস্তিনিরাও আনন্দে মেতে ওঠে। মসজিদে মসজিদে দোয়া হয় এবং মুসল্লিরা দলবেঁধে তারাবির নামাজে যোগ দেয়। মুসল্লিরা ফানুস নিয়ে বের হয়। অভিভাবকরা শিশুদের ফানুস কিনে দেয়। রাস্তায় রাস্তায় ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান বসে।
মরক্কো : মরক্কোর অধিবাসীরা ‘বরকতময় দশক’ শব্দ দ্বারা পরস্পরকে অভিনন্দন জানায়। এর দ্বারা মূলত রমজানের তিনটি ভাগের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়। রমজান আগমনের আনন্দ প্রকাশ করতে মরক্কোর অধিবাসীরা পরস্পরকে মিষ্টিমুখ করায়। শিশুরা মসজিদের মুসল্লিদের ভেতর মিষ্টি বিতরণ করে।
আলজেরিয়া : প্রচারমাধ্যমগুলোতে রমজান আগমনের সংবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে আলজেরিয়ার শহরগুলোতে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তারা পরস্পরকে অভিনন্দন জানায়। শিশুরা রাস্তায় বের হয়ে ঐতিহ্যবাহী গানগুলো গায়। যেসব গানে রমজানের মাহাত্ম্য ও রোজা রাখার আহ্বান থাকে। কোনো কোনো গানে যারা রোজা রাখে না তাদের ভর্ত্সনা করা হয়।
মালয়েশিয়া : রমজানের চাঁদ দেখার পর মালয়েশিয়ানরাও দফ বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তোপধ্বনি দেওয়া হয়। মালয়েশিয়ান সরকার চাঁদ দেখার সংবাদ প্রচারের পাশাপাশি প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে পানি ছিটায়, জনসমাগমের স্থানগুলো পরিষ্কার করে, রাস্তা ও মসজিদের শোভাবর্ধনে আলোকসজ্জা করা হয়। মসজিদগুলোও পরিষ্কার করা হয় এবং সেখানে ধূপ দেওয়া হয়। রমজানে মালয়েশিয়ান নারীরা ইফতার ও সাহরির মধ্যবর্তী সময়ে বিভিন্ন বাড়িতে কোরআন তিলাওয়াতের জন্য একত্র হয়। তাদের ‘তাওয়ায়িফ’ বলা হয়।
ইন্দোনেশিয়া : ইন্দোনেশিয়ার ধর্ম মন্ত্রণালয় চাঁদ দেখার ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘লুবরান’ শুরু হয়। তা হলো একটি বিশেষ আচার উৎসব। লুবরানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক সপ্তাহের জন্য ছুটি থাকে। এ সময় পুরুষরা দলবেঁধে মসজিদে যায় তাবারির নামাজ আদায় করতে। মসজিদের মিনারগুলোতে আলোকসজ্জা করা হয়।
কমোরোস দ্বীপপুঞ্জ : রমজানের প্রথম রাতে কমোরোসের মুসলিমরা চাঁদ দেখতে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে একত্র হয়। তখন তারা মশাল বহন করে। মশালের আলো সমুদ্রের পানিতে প্রতিবিম্ব তৈরি করে। রমজান আগমনের সংবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে তারা তবলা বাজিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। সাহরি খাওয়া পর্যন্ত তারা সমুদ্র পারেই অবস্থান করে।