জন্মের পর মায়ের অবহেলায় মরতে বসেছিল এক ব্যাঘ্রশাবক। চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার এক চিকিৎসকসহ কর্মীরা বাঘের ছানাটিকে নিজেদের কাছে রেখে পূরণ করেন মায়ের মমতার অভাব। নিজেরাই দুধ খাইয়ে, নিবিড় পরিচর্যা করে, পেলে-পুষে বাঘের ছানাটিকে বাঁচিয়ে তোলেন। সাড়ে পাঁচ মাস পর ‘বাইডেন’ নামের বাঘের ছানাটিকে খাঁচায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
২১ এপ্রিল ২০২১ বুধবার চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার পরিচালনা পরিষদের সদস্য সচিব ও হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমীন এবং চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর ডা. শাহাদাত হোসেন শুভ বাঘের ছানাটিকে নতুন নির্মিত একটি খাঁচায় রাখেন। এর মধ্য দিয়ে বাঘ শাবকটির মানুষের যত্নে-মমতায় আর সান্নিধ্যে দিনযাপনের অবসান হয়েছে। এখন সেটি চিড়িয়াখানার অন্যান্য বাঘদের মধ্য থেকে নিজের সঙ্গী খুঁজে নেবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত বছরের ১৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় বাঘিনী জয়া’র ঘরে জন্ম নেয় তিন শাবক। এর মধ্যে পরদিন একটি শাবক এবং ১৮ নভেম্বর আরও একটি শাবক মারা যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় থাকা আরেকটির প্রাণ রক্ষায় নিজের হেফাজতে নেন ডা. শুভ। ওই সময় ৪৬তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের জয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে এসেছিল। ডা. শুভ তখন বাঘের ছানাটির নাম রাখেন ‘বাইডেন’।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর শাহাদাৎ হোসেন শুভ বলেন, ‘মা বাঘিনীর কাছ থেকে দুধ না পেয়ে দু’টি শাবক মারা যায়। এই শাবকটিরও একই অবস্থা হয়েছিল। অনেক সময় সন্তান জন্মদানের পর মা বাঘের কিছু পরিবর্তন ঘটে। তারা সন্তানদের কাছ থেকে দূরে থাকে, হিংস্র আচরণ করে। অন্যদিকে সাধারণত ৪৮ ঘণ্টা দুধ না পেলে শাবক বাঁচে না। এগুলোর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হয়েছিল।
নিজের হেফাজতে নিয়ে বাঘিনী জয়ার শাবককে নিজের অফিসকক্ষেই রাখেন শুভ। গত প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস ধরে নিজেই ফিডারে করে দুধ খাইয়েছেন, যেভাবে ছোট ছোট শিশুদের খাওয়ানো হয়। শাবকটির পাশে রেখেছেন বাঘ আকৃতির খেলনা। কাপড়-বল দিয়ে বাঘ শাবকটির সঙ্গে দিনের নির্দিষ্ট সময় খেলাধুলায় কাটিয়েছেন চিড়িয়াখানার কর্মীরা। এভাবে আস্তে আস্তে শঙ্কামুক্ত হয়ে সজীব ও চঞ্চল হয়ে ওঠে শাবকটি।
ডা. শুভ বলেন, ‘শুধু দুধ খাইয়ে শাবকটির প্রাণ রক্ষা করা সহজ ছিল না। কারণ সংক্রমণের আশঙ্কা ছিল। দুধ খাওয়ানোর পর হজমের সমস্যা হচ্ছিল। ওজনও কমতে শুরু করেছিল। এমনিতেই জন্মের পর মায়ের দুধ না পেয়ে সেটি খুব দুর্বল ছিল। আমরা স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে শাবকটিকে বাঁচিয়ে তুলি। আবার সেটি যেন বাঘের স্বাভাবিক আচরণ প্রকাশ করতে পারে, সেজন্য ওর লালনপালনের ক্ষেত্রে নানা কৌশল নিয়েছি। সাড়ে পাঁচ মাস পর বাঘ শাবকটি এখন পুরোপুরি সুস্থ সবল আছে। এর ওজন ২১ কেজির সামান্য বেশি।
সাধারণত এক বছর বয়স থেকে বাঘ স্বাভাবিক আচরণ প্রকাশ করতে শুরু করে জানিয়ে শুভ বলেন, ‘আমরা খাঁচায় বাঘ শাবকটি রেখেছি, যেন সে অন্যান্য বাঘ দেখে তার আচরণ বুঝে নেয়। আপাতত সে খাঁচায় একা থাকবে। যেহেতু এতদিন আমরা তাকে সঙ্গ দিয়েছি, সেজন্য হঠাৎ যেন সে নিজেকে নিঃসঙ্গ না ভাবে, সেজন্য আমরা নিয়মিত খাঁচায় ঢুকব। দুধ খাওয়াব। আরও কিছুদিন সঙ্গ দেবো। তারপর আস্তে আস্তে সে নিজের সঙ্গী খুঁজে নেবে।
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৩৩ লাখ টাকায় কেনা একটি ১১ মাস বয়সী বাঘ ও ৯ মাস বয়সী বাঘিনী চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় আনা হয় ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর। চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় ঘটা করে তাদের বিয়ে দেওয়া হয়, নাম দেওয়া হয় রাজ ও পরী।
সেই বেঙ্গল টাইগার রাজ-পরী দম্পতির ঘরে ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই জন্ম নেয় তিন শাবক। এর মধ্যে দু’টি ছিল ‘হোয়াইট টাইগার’, আরেকটি কমলা-কালো ডোরাকাটা। একটি সাদা বাঘ শাবক জন্মের পরদিনই মারা যায়। সাদা বাঘিনী ‘শুভ্রা’ বেঁচে আছে। কমলা-কালো ডোরাকাটা শাবকটির নাম দেওয়া হয় ‘জয়া’।
সেই ‘জয়া’ গত বছরের ১৪ নভেম্বর জন্ম দেয় তিনটি শাবকের। এই তিন শাবক জয়া’র প্রথম সন্তান, যার দু’টি মারা গেছে। বেঁচে আছে একমাত্র ‘বাইডেন’, যেটি জন্মের পরের প্রথম সাড়ে পাঁচ মাস মানুষের ঘরে কাটিয়ে এখন খাঁচায় ফিরে গেল।