এ কে আজাদ: কাফি খান। বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ পাঠক এবং অভিনেতা। অভিনয় শুরু করেছিলেন মঞ্চ ও বেতার-এ। এক সময় সংবাদ পাঠক হিসেবেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন । ভরাট কণ্ঠের অধিকারী কাফি খান, একজন সুপ্রিয় সংবাদ পাঠক হিসেবে অগণিত মানুষের ভালোবাসা ও প্রশংসা পেয়েছেন আজীবন।
তিনি এদেশের টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের প্রথম দিকের একজন অভিনেতা। উঁচুমানের একজন গুণী অভিনেতা হয়েও তিনি খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন সুপ্রিয় সংবাদ পাঠক হিসেবে।
সুপ্রিয় সংবাদ পাঠক-অভিনেতা কাফি খান এর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০২১ সালের ২ জুলাই, যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া সেন্টার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। এই গুণি মানুষটির স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
কাফি খান ১৯২৬ সালের ২০ মে, পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসাত মহকুমার কাজীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি বারাসাত সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন কলকাতার রিপন কলেজ থেকে। এরপর কাফি খান চাকরির পাশাপাশি নাইট কলেজে পড়াশোনা চালিয়ে যান। স্কুল-কলেজে পড়াশোনাকালীন সময়েই তিনি আবৃত্তি চর্চার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দেশ বিভাগের পরপরই ১৯৪৮ সালে চলে আসেন ঢাকায়।
ঢাকায় এসেই সরকারি চাকরির পাশাপাশি শুরু করেন নাট্যচর্চা। বেতারে ও মঞ্চনাটকে অভিনয় শুরু করেন কাফি খান। মঞ্চে তিনি যেসব নাটকে অভিনয় করেছেন তারমধ্যে- ‘নার্সিং হোম’, ‘দুই পুরুষ’, ‘কালিন্দী’, ‘বিশ বছর আগে’ এবং ‘দেবদাস’ উল্লেখযোগ্য। এসব নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
আতিকুল হক চৌধুরী প্রযোজিত বেতার নাটক ‘শেষের কবিতা’য় অমিত চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে সে সময়ে বেশ খ্যাতি লাভ করেন। মঞ্চ ও বেতার নাটকে তাঁর নায়িকা ছিলেন- লিলি চৌধুরী, হোসনে আরা বিজু, দিলারা হাসেম, সুমিতা দেবী, খুরশীদি খানম প্রমুখ।
সেই সময়কার বেতার প্রযোজক মহিউদ্দিন পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘মাটির পাহাড়’ এ সুলতানা জামান ও ডাঃ রওশন আরার বিপরীতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে আসেন তখনকার সময়ের বেতার ও মঞ্চ নাটকের অতি সুপরাচিত মুখ কাফি খান। ‘মাটির পাহাড়’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে।
মহিউদ্দিন পরিচালিত, সৈয়দ শামসুল হক রচিত এবং সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ প্রযোজিত ‘মাটির পাহাড়’ ছবিতে তিনি ‘ইকবাল’ নামে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
কাফি খান আরো যেসব চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন- ‘তোমার আমার’, ‘দুই দিগন্ত’, ‘অনেক দিনের চেনা’, ‘ রাজা সন্যাসী’, ‘উলঝন’ (উর্দু ছবি), ‘সূর্য কন্যা’, ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘রূপালী সৈকতে’, ‘আকাঙ্ক্ষা’ প্রভৃতি ।
এসব চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি বেশ প্রশংসিত হয়েছিলেন। তারপরও বহু বছর তাঁকে আর কোনো ছবিতে অভিনয় করতে দেখা যায়নি। তবে দীর্ঘ ৩ যুগ পর, কয়েক বছর আগে দেশে বেড়াতে এলে, পরিচালক এনামুল করিম নির্ঝরের ‘নমুনা’ ছবিতে অভিনয় করেন কাফি খান।
১৯৬৫ সালে, ঢাকা টেলিভিশনের শুরুতেই বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন কাফী খান। একই বছর তিনি কলিম শরাফীর আহবানে টিভিতে সংবাদ পাঠ শুরু করেন ।
কাফী খান ১৯৬৬ সালে, চলে যান আমেরিকায়। সেখানে ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ পাঠক হিসেবে যোগ দেন।
১৯৭৩ সালে দেশে ফিরে আসেন কাফী খান। আবারও তিনি অভিনয় ও টেলিভিশনে সংবাদ পাঠে মনোযোগ দেন। ধীরে ধীরে একজন প্রথম সারিড় সংবাদ পাঠক হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
১৯৭৬ সালে সর্বপ্রথম জাতীয় টেলিভিশন পুরুস্কারে তিনি বাংলায় শ্রেষ্ঠ সংবাদ পাঠকের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
১৯৭৭ থেকে ৮২ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সরকারের প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯৮২ সালে আবারও ভয়েস অব আমেরিকায় যোগ দেন। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানেই পেশাগত কাজে জড়িত ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নর্দান ভার্জিনিয়ার গ্রেটফলসে স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।