এ কে আজাদ: বাদল রহমান। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এজজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। ছিলেন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বদের অন্যতম একজন । বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশে সামগ্রিক আন্দোলনের একজন প্রথম সারির সৈনিক ছিলেন তিনি। আমাদের চলচ্চিত্রে, শিল্প-সংস্কৃতিতে ও মহান মুক্তিযুদ্ধে রেখেছেন অনন্য অবদান।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, চলচ্চিত্র নির্মাতা বাদল রহমান এর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০১০ সালের ১১ জুন, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬১ বছর। গুণি এই চিত্রনির্মাতার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
বাদল রহমান (মাহবুবুর রহমান) ১৯৪৯ সালের ৪ জুন, পাকিস্তানের করাচীতে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর বাবার বদলীর চাকুরীর কারণে কয়েক জেলায় বিভিন্ন স্কুলে পড়তে হয়েছে তাঁকে। ১৯৫৭ সালে পিতার বদলি হয় খুলনায়, সেখানে তিনি ‘সেন্ট জোশেফ স্কুল’-এ চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ময়মনসিংহের ‘নান্দিনা পাইলট হাই স্কুল’ থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, এরপরে জগন্নাথ কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন।
জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময় ১৯৬৭ সালে তিনি রেডিওতে ছোটদের অনুষ্ঠান খেলাঘর-এর চিত্রনাট্য লেখার সুযোগ পান। রেডিওর পাশাপাশি তখন টেলিভিশনের ছোটদের অনুষ্ঠানেরও চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন।
পরিচালক মমতাজ আলীর ‘নতুন নামে ডাকো’ (১৯৬৯) ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার মধ্যদিয়ে বাদল রহমান প্রথম চলচ্চিত্রে আসেন। পরবর্তীতে পরিচালক রাজেন তরফদারের ‘পালঙ্ক’ ছবিতেও সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন তিনি।
বাদল রহমান পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়তে যান ১৯৭৩ সালে। ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া থেকে ফিল্ম এডিটিংয়ে ডিপ্লোমা শেষ করেন। তাঁর নির্মিতি প্রথম চলচ্চিত্র ‘প্রত্যাশার সূর্য’ (সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী’র সাথে যৌথভাবে পরিচালনা করেন)।
বাদল রহমান নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্র- এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী (পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্র), সেলফ পোট্টেট, শিল্পীর শিল্প, কাঁঠাল বুড়ির বাগান, ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ (স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র), মুজিবের ছেলেবেলা, গায়ত্রী সন্ধ্যা (প্রামাণ্য চলচ্চিত্র)।
এমিলার গোয়েন্দা বাহিনী চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র প্রযোজক, শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব-চরিত্র অভিনেতা, শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী, শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক এবং শ্রেষ্ঠ সম্পাদনা এই পাঁচটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। যার মধ্যে বাদল রহমান শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র প্রযোজক ও শ্রেষ্ঠ সম্পাদনা এই দুইটি বিভাগে পুরস্কার অর্জন করেন।
তিনি চলচ্চিত্রে ও নাটকে অভিনয়ও করেছেন। চলচ্চিত্র নিয়ে লেখা-লেখিও করেছেন প্রচুর। ‘চলচ্চিত্রের ভাষা’ নামে তাঁর একটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, চলচ্চিত্র পরিচালক, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বাদল রহমান, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বদের অন্যতম একজন ছিলেন।
তাঁর মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি ‘বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিস’-এর সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির বিকাশে অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক অনেক সম্মাননায় সম্মানিত হয়েছেন। যার মধ্যে- বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশে দীর্ঘ ৫০ বছর নিরবচ্ছিন্ন অবদানের জন্য ‘হীরালাল সেন আজীবন সম্মাননা’, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘সুবর্ণ জয়ন্তী পদক’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ আজীবন সম্মাননা-২০১৭’ অন্যতম।
বাংলাদেশে চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশের আন্দোলনে পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন বাদল রহমান। এদেশের চলচ্চিত্র, সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশে সামগ্রিক আন্দোলনের একজন অভিভাবক ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে, শিল্প-সংস্কৃতিতে ও মহান মুক্তিযুদ্ধে বাদল রহমান-এর অনন্য অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।