বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা, প্রযোজক, মারপিট পরিচালক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা জসিম-এর ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৯৮ সালের ৮ অক্টোবর, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৮ বছর। অকাল প্রয়াত অভিনেতা জসিম-এর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
অভিনেতা জসিম (আবুল খায়ের জসিম উদ্দিন) ১৯৫১ সালের ১৪ আগস্ট, ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বক্সনগর গ্রামে, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। তিনি লেখাপড়া করেন বি.এ পর্যন্ত।
১৯৭১-এ যখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন জসিম ছিলেন কলেজ ছাত্র। বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। দুই নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জসিম।
নায়ক আজিম প্রযোজিত ও শেখ লতিফ পরিচালিত ‘দেবর’ ছবির মাধ্যমে প্রথম চলচ্চিত্রে আসেন জসিম। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশের প্রথম অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র ‘রংবাজ’-এ অ্যাকশন ডিরেক্টর হিসেবে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করেন তিনি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অ্যাকশনের পথপ্রদর্শক হিসেবে আজও কিংবদন্তী হয়ে আছেন জসিম।
মারপিট পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে আসা জসিম, শুরুর দিকে ছোট-খাটো দৃশ্যে অভিনয় করতেন। পরবর্তীতে দেওয়ান নজরুল পরিচালিত ‘দোস্ত দুশমন’ চলচ্চিত্রে প্রধান খলনায়কের ভুমিকায় অভিনয় করে ব্যাপক পরিচিতি পান। ‘দোস্ত দুশমন’ সাড়াজাগানো হিন্দি চলচ্চিত্র ‘শোলে’র পুন:র্নিমাণ। ছবিটিতে তিনি ‘গাফফার’ চরিত্রে অভিনয় করে, খলঅভিনেতা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান।
খলচরিত্রের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করলেও পরবর্তীকালে নায়ক হিসেবেও জসিম সফলতা পেয়ে ছিলেন। নায়ক হিসেবে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওমর শরীফ’ । দেলোয়ার জাহান ঝন্টু পরিচালিত ১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, এই ছবিতে তিনি নায়ক হিসেবে দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। সেই থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছিলেন বাণিজ্যিক ছবির সফল চিত্রনায়ক।
জসিম অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো- দুশমন, দুই রাজকুমার, এক মুঠো ভাত, কাজল রেখা, নিশান, দোস্ত দুশমন, রাজদুলারী, আসামী হাজির, মহেশখালীর বাঁকে, নাগ নাগিনী, বিজয়িনী সোনাভান, সুন্দরী, প্রতিজ্ঞা, বাহাদুর, বারুদ, বন্দুক, আলী আসমা, জিঘাংসা, গাদ্দার, বাঁধন হারা, মিন্টু আমার নাম, ডাকু মনসুর, যাদুনগর, শাহী দরবার, মান সম্মান, শাহজাদা, তুফান, যুবরাজ, রং বেরং, নাগ নাগিনী, দাতা হাতেমতাই, নওজোয়ান, মাই লাভ, চিৎকার, লাভ ইন সিঙ্গাপুর, চ্যালেঞ্জ, সিআইডি, গুনাহগার, লুটেরা, হুর এ আরব, মোকাবেলা, কসাই, নবাবজাদী, বাঁধনহারা, ওস্তাদ সাগরেদ, সবুজ সাথী, সেলিম জাভেদ, লাইলী মজনু, ঘরের বউ, জনি, নাজমা, অভিযান, জিদ্দি, আক্রোশ, অশান্তি, বউ কথা কও, নিষ্পাপ, রকি, হিরো, নেপালি মেয়ে, হাসান তারেক, সালতানাৎ, শত্রু, ধর্ম আমার মা, লালৃু মাস্তান, সারেন্ডার, সুখ শান্তি, আদিল, ভাইজান, ছোট বউ, ধনরত্ন, বিস্ফোরণ, কাজের বেটি রহিমা, ন্যায় অন্যায়, লক্ষ্মীর সংসার, মাস্তান রাজা, শান্তি অশান্তি, হিংসা, নাগ নাগিনীর প্রেম, আশিক প্রিয়া, কালিয়া, তুফান, জবাব, মহল, বদলা, কুরবানী, বাংলার নায়ক, পরিবার, রাজা বাবু, বুকের ধন, লাল গোলাপ, দাগী, টাইগার, হাবিলদার, ঘাত প্রতিঘাত, গরীবের সংসার, গরীবের ওস্তাদ, নিষ্ঠুর, স্বামী কেন অাসামী, ফাইভ রাইফেলস, ভালবাসার ঘর, মেয়েরাও মানুষ, ইত্যাদি ।
অভিনেতা ছাড়াও জসিম ছিলেন একজন সফল প্রযোজক । তিনি তাঁর বন্ধুদের (গুই, আমান ও বাবুল) নিয়ে গড়ে তোলেন চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘জ্যাম্বস প্রোডাকশন্স প্রাঃ লিঃ’। এই প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মিত হয় অনেক ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র, যার মধ্যে রয়েছে- দোস্ত দুশমন, বারুদ, ওস্তাদ সাগরেদ, জনি, আক্রোশ, হিরো, ভাইজান, কাজের বেটি রহিমা, বাংলার নায়ক, মাস্তান রাজা, কালিয়া, গরীবের ওস্তাদ, প্রভৃতি।
ব্যক্তিজীবনে জসিম প্রথম বিয়ে করেছিলেন চিত্রনায়িকা সুচরিতা’কে। পরে তিনি ঢাকার প্রথম সবাক ছবির নায়িকা পূর্ণিমা সেনগুপ্তার মেয়ে, নায়িকা নাসরিন’কে বিয়ে করেন। জসিম ও নাসরিন দম্পতীর তিন ছেলে। রাতুল, রাহুল ও সামি।
অসাধারণ মেধাবী-প্রতিভাবান অভিনেতা ছিলেন জসিম। সাধারণ এক্সট্রা ভিলেন/খলনায়ক থেকে জাঁদরেল ভিলেন/খলনায়ক। অতঃপর জাঁদরেল ভিলেন/খলনায়ক থেকে জনপ্রিয় নায়ক/ অ্যাকশন কিং হিরো। অভিনয়ের এমন কঠিন সমিকরণ পেরেয়ি একসময় সাধারণ সিনেমাদর্শকদের প্রাণপ্রিয় নায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন জসিম। নিজেকে রাফ অ্যান্ড টাফ হিরোর ইমেজে গড়ে তুলে ছিলেন। চলচ্চিত্রে ধুন্ধুমার অ্যাকশন দেখিয়ে, নিজের অভিনীত সব ছবিকে হিট-সুপারহিট পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অ্যাকশন এবং আধুনিক অ্যাকশনের প্রবর্তক/জনক তিনি। সামাজিক অ্যাকশন ধারার চলচ্চিত্রকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য এক উচ্চতায়। জসিম তাঁর বন্ধু ও সহযোদ্ধা গুই, আমান ও বাবুলদের নিয়ে ‘জ্যাম্বস ফাইটিং গ্রুপ’ গড়ে তুলেন। যারা সেই মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তিকে জয় করে দারুণ সব অ্যাকশন দৃশ্য পর্দায় যুক্ত করে, অসংখ্য ব্যবসা সফল, জনপ্রিয় ও সুপারহিট অ্যাকশন ছবি উপহার দিয়ে গেছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, সফল চলচ্চিত্র অভিনেতা-প্রযোক জসিম। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তাঁর অবদান অবশ্য অবশ্যই স্মরণযোগ্য।