আজাদ আবুল কাশেম: বাংলাদেশের সিনেমাপর্দা হাসির বন্যায় ভাসিয়ে, কৌতুক অভিনয়কে সমৃদ্ধ করেছেন যিনি। বিশেষ করে চলচ্চিত্রে কৌতুককে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। সেই অসম্ভব জনপ্রিয় অভিনেতা, আনন্দময় মানুষ টেলি সামাদ। আজ তাঁর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল, ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। প্রয়াত এই প্রতিভাবান অভিনয়শিল্পীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
অত্যান্ত জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা টেলি সামাদ (আবদুস সামাদ)-এর জন্ম ১৯৪৫ সালের ৮ জানুয়ারি, মুন্সীগঞ্জ জেলার নয়াগাঁও গ্রামে। লেখাপড়ার পাশাপাশি মুন্সিগঞ্জ শহরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, মঞ্চনাটক ও সংগীত অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিত অংশ গ্রহণ করতেন।
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা টেলি সামাদ, তাঁর বড় ভাই বিখ্যাত চারুশিল্পী আব্দুল হাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে বিএফএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছাত্রাবস্থায়ই চলচ্চিত্র পরিচালক নজরুল ইসলামের সাথে তাঁর পরিচয় হয় । সেই সূত্রধরে নজরুল ইসলাম তাঁর পরিচালিত ‘কার বউ’ চলচ্চিত্রে ছোট্ট একটা চরিত্রে টেলি সামাদকে অভিনয় করার সুযোগ দেন। ‘কার বউ’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালে।
মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে সমানতালে জনপ্রিয়তা পাওয়া টেলি সামাদ অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ময়নামতি, মায়ার বাঁধন, পায়ে চলার পথ, অবাক পৃথিবী, বেঈমান, টাকার খেলা, মালকা বানু, উপহার, সুজন সখি, হাসি কান্না, নয়নমণি, মনের মানুষ, চাষীর মেয়ে, যাদুর বাঁশী, গুন্ডা, জিঘাংসা, বাদশা, আগুনের আলো, গুনাহগার, মাটির মায়া, পিঞ্জর, বধূ বিদায়, তৃষ্ণা, কুয়াশা, শাপ মুক্তি, জয় পরাজয়, মতিমহল, মা, গোলাপী এখন ট্রেনে, অশিক্ষিত, আসামী হাজির, ফকির মজনু শাহ্, সোহাগ, তুফান, বিজয়িনী সোনাভান, সোনার হরিণ, বৌরাণী, পাগলা রাজা, মাস্তান, মধুমিতা, শেষ পরিচয়, মিন্টু আমার নাম, হারানো মানিক, দি ফাদার, মাটির ঘর, দিন যায় কথা থাকে, কন্যাবদল, নদের চাঁদ, নাগরদোলা, চোখের মনি, শহর থেকে দূরে, নওজোয়ান, লাভ ইন সিংগাপুর, দি ফাদার, চম্পা চামেলি, আলিফ লায়লা, মাসুম, কথা দিলাম, শেষ উত্তর, গাঁয়ের ছেলে, বাদল, ভালো মানুষ, ঘরণী, কলমী লতা, আলতা বানু, বড় বাড়ির মেয়ে, আমির ফকির, দিলদার আলী, লাল কাজল, খোকন সোনা, নতুন বউ, মান অভিমান, মনাপাগলা, এতিম, মায়ের আঁচল, পরিবর্তন, সখিনার যুদ্ধ, কালো গোলাপ, হিসাব নিকাশ, ভাতদে, পরাণ পাখি, নসীব, জয়পরাজয়, মিস লোলিতা, লাল মেমসাহেব, নেপালি মেয়ে, দেশবিদেশ, হাসনা হেনা, অভাগী, সাধনা, দিদার, হীরামতি, আমার সংসার, রঙ্গীন সাতভাই চম্পা, বিশাল, ক্ষমা, ফুলেশ্বরী, কেয়ামত থেকে কেয়ামত, মিষ্টার মওলা, নিষ্পাপ বধূ, আজকের শয়তান, আমি নির্দোষ, ডাইনি বুড়ি, মায়ের হাতে বেহেস্তের চাবি, রাজা সূর্য খাঁ, জিরো ডিগ্রী, ইইত্যাদি।
কাজী হায়াৎ পরিচালিত, তাঁর নিজের প্রযোজিত ছবি ‘দিলদার আলী’তে (১৯৮০) তিনি নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। ‘মনা পাগলা’ (১৯৮৪) চলচ্চিত্রে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করার পাশাপাশি কণ্ঠশিল্পী, সুরকার-গীতিকার, সংগীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন টেলি সামাদ।
মতিমহল, দিলদার আলী, তুফান, নবাব ও ঘরণী’সহ তিনি আরো বেশকিছু চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন।
চলচ্চিত্রে তাঁর গাওয়া অনেক গান সেই সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। টেলি সামাদ-এর গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্য আছে- দিওয়ানা বানাইয়া খাইছে আমায় গিল্লা….., দিলদার আলী আমার নাম খেইল দেখানো আমার কাম……., ও জুলিয়া প্রাণ খুলিয়া দে…….., দোস্ত আমার ইস্কাপানের টেক্কা……., ময়না তোর দেহখানি সুন্দর করি কোন রসিয়া বানাইয়াছে,,, প্রভৃতি।
তিনি একাধারে অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী, সুরকার-গীতিকার, সংগীত পরিচালক, চিত্রপ্রযোজক ও অঙ্কন শিল্পী।
বহুমাত্রিক প্রতিভাধর, জাতশিল্পী টেলি সামাদ তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী অভিনয় শৈলি দিয়ে দর্শকদের বিনোদিত করেছেন, বিমোহিত করেছেন।
সমানতালে অভিনয় করেছেন সিনেমায়, টেলিভিশনে। পেয়েছেন তুমুল জনপ্রিয়তা। হাসির রাজপুত্র, এসেছিলেন পৃথিবীকে হাসাতে। হাসিয়েছেন-ভাসিয়েছেন আনন্দের বন্যায়, চলচ্চিত্রের রূপালী পর্দায়। বহু গুণে গুণান্বিত, কিংবদন্তিতুল্য কৌতুক অভিনেতা টেলি সামাদ, আমাদের স্মৃতির পাতায়, হৃদয়ের মাঝখানে অম্লান- চিরদিন।