এ কে আজাদ: জহির রায়হান। সাংবাদিক-সাহিত্যিক, ভাষা সৈনিক-মুক্তিযোদ্ধা, চলচ্চিত্র পরিচালক-প্রযোজক। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ক্ষণজন্মা-বিস্ময়কর প্রতিভা প্রবাদ পুরুষ জহির রায়হান। সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে অনন্য অবদান রেখে গেছেন আমাদের শিল্প-সংস্কৃতিতে। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মধ্যে সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের একটি তাঁর নির্মিত ‘জীবন থেকে নেয়া’। আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধেও রেখেছেন অসাধারণ ভূমিকা। সত্য ও সাহসিকতায় জাতির সূর্য সন্তান তিনি। প্রখ্যাত সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাতা, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ জহির রায়হান-এর ৫২তম অন্তর্ধান দিবস আজ।
নিখোঁজ বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে (যিনি স্বাধীনতার ঠিক আগমুহূর্তে পাকিস্তানী আর্মির এদেশীয় দোসর আল বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন) ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি, ঢাকার মীরপুরে তিনি নিজেই নিখোঁজ হয়ে যান (তখন ঢাকার অদূরে অবস্থিত মীরপুর ছিল বিহারী অধ্যুষিত এলাকা)। পরবর্তিতে অনেকের অনুসন্ধানী রিপোর্ট অনুযায়ী প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, সেদিন বিহারী ও ছদ্মবেশী পাকিস্তানী সৈন্যদের গুলিতে জহির রায়হান শহীদ হন। শহীদ জহির রায়হান-এর প্রতি অন্তহীন শ্রদ্ধাঞ্জলি।
জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট, ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলার, নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুরে, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক নাম, আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ডাক নাম ছিল ‘জাফর’। প্রাথমিক লেখাপড়া করেছেন ‘মিত্র ইন্সটিটিউট’ ও ‘আলিয়া মাদ্রাসা’ কলকাতায়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি তাঁর পরিবারের সাথে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন। ১৯৫০ সালে ‘আমিরাবাদ হাইস্কুল’ (ফেনী) থেকে মেট্রিকুলেশন ও ১৯৫৩-তে ‘জগন্নাথ কলেজ’ (ঢাকা) থেকে আই.এস.সি পাস করেন, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ১৯৫০ সালে ‘যুগের দাবী’ পত্রিকায় প্রথম লেখালিখি শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া, যাত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেছেন।
১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে যে ক’জন তরুণ প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং যে ১০ জন ব্যক্তি প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিলেন, জহির রায়হান সেই ১০ জনের অন্যতম একজন। ভাষা আন্দোলনে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘পোস্টার’ নামে একটি গল্প ও ‘আরেক ফাল্গুন’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। ১৯৫৫ সালে, তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সূর্যগ্রহণ’ প্রকাশিত হয়। ১৯৫৬ সালে, তিনি সম্পাদক হিসেবে ‘প্রবাহ’ পত্রিকায় যোগ দেন।
১৯৫৭ সালে, এ জে কারদার পরিচালিত ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ চলচ্চিত্রে, সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজের মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ করেন। তখন তিনি সহকারি পরিচালক হিসেবে আরো কাজ করেন চিত্রপরিচালক সালাউদ্দীনের ‘যে নদী মরুপথে’ ও এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন ‘কখনো আসেনি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে, ১৯৬১ সালে। জহির রায়হান নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্রসমূহ- সোনার কাজল (কলিম শরাফী এর সাথে যৌথভাবে নির্মিত), কাঁচের দেয়াল, সঙ্গম (উর্দু, সমগ্র পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে নির্মিত প্রথম রঙ্গীন চলচ্চিত্র), বাহানা (উর্দু, সমগ্র পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে নির্মিত প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র), বেহুলা, আনোয়ারা, জ্বলতে সুরুজ কি নীচে, জীবন থেকে নেয়া, লেট দেয়ার বি লাইট (মুক্তি পায়নি)। প্রামাণ্যচিত্র- স্টপ জেনোসাইড, এ স্টেট ইজ বর্ন ।
জহির রায়হান বেশকিছু চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছেন- দুই ভাই, কুচবরণ কন্যা, জুলেখা, সুয়োরাণী দুয়োরাণী, সংসার, মনের মত বউ, শেষ পর্যন্ত, প্রতিশোধ, লিবারেশন ফাইটার্স (প্রামাণ্যচিত্র), ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স (প্রামাণ্যচিত্র) প্রভৃতি।
সাহিত্যিক জহির রায়হান-এর রচনাসমূহ (উপন্যাস)- শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী, আর কত দিন, কয়েকটি মৃত্যু, একুশে ফেব্রুয়ারি, তৃষ্ণা। এছাড়াও তিনি বহু গল্পগ্রন্থ রচনা করেন। অনেক পত্র-পত্রিকায় কবিতা ও প্রবন্ধও রচনা করেছেন ।
জহির রায়হান তাঁর সৃজনশীল কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। যার মধ্যে- ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের জন্য আদমজী সাহিত্য পুরস্কার-১৯৬৪, ‘কাঁচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র বিভাগে নিগার পুরস্কার-১৯৬৫, গল্প সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার-১৯৭২ (মরণোত্তর), শিল্পকলায় (চলচ্চিত্র) অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ‘একুশে পদক’-১৯৭৭ (মরণোত্তর), সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার-১৯৯২ (মরণোত্তর), ‘হাজার বছর ধরে’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার- ২০০৫ (মরণোত্তর)।
জহির রায়হান ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান শুরু করেন ও তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’র বান্যিজিক প্রদর্শনী হয় কলকাতায়, সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন ।
ব্যক্তিজীবনে জহির রায়হান, প্রথম বিয়ে করেন তখনকার সময়ের খ্যাতিমান নায়িকা সুমিতা দেবী’কে। এ সংসারে তাদের দু’টো পুত্র সন্তান রয়েছে। বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান, দু’জনই শিল্প-সংস্কৃতির সাথে জড়িত।
জহির রায়হান পরবর্তীতে বিয়ে করেন, আরেক চিত্রনায়িকা সুচন্দা’কে। এই সংসারেও তাদের দুই পুত্রসন্তান- অপু রায়হান ও তপু রায়হান। তপু রায়হান চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র তথা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির কৃতিমান ব্যক্তিত্ব জহির রায়হান শারীরিকভাবে চলে গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর কর্ম ও জীবন। তাঁর চিন্তা-চেতনা, তাঁর আদর্শ। চলচ্চিত্র তথা শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির সাথে সংশ্লিষ্টরা যতবেশী জহির রায়হানের মতো কৃতিমান ব্যক্তিত্ব তথা মানুষকে অনুসরণ করবেন এবং তাঁর কর্ম নিয়ে চর্চা করবেন, ততবেশী সমৃদ্ধ হবে আমাদের চলচ্চিত্র তথা শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গন।