English

25 C
Dhaka
রবিবার, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪
- Advertisement -

বাংলা গানের জনপ্রিয় সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব আলম খান এর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ

- Advertisements -

এ কে আজাদ: আলম খান। গীতিকার, সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক। প্রখ্যাত সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব, অসংখ্য কালজয়ী জনপ্রিয় বাংলা গানের কিংবদন্তী সুরশ্রষ্টা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গানের বহুল জনপ্রিয় সুরকার-সঙ্গীত পরিচালক। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গানের সফল সমৃদ্ধিতে যাঁদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাদের মধ্যে অন্যতম একজন আলম খান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অসংখ্য অসংখ্য জনপ্রিয় সুপারহিট গানের সুরকার তিনি। বাংলাদেশের সঙ্গীতজগতের অসম্ভব প্রতিভাবান মেধাবী গুণি ব্যক্তিত্ব। বাংলা গানের এই অসম্ভব জনপ্রিয় সঙ্গীতব্যক্তিত্বের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০২২ সালের ৮ জুলাই, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। মৃত্যুদিবসে এই গুণি সঙ্গীতজ্ঞের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

আলম খান (খুরশিদ আলম খান) ১৯৪৪ সালের ২২ অক্টোবর, সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার বানিয়াগাঁতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আফতাব উদ্দিন খান ছিলেন সেক্রেটারিয়েট হোম ডিপার্টমেন্ট এর এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার ও মা জোবেদা খানম ছিলেন গৃহিণী। পাঁচ ভাই তিন বোনের মধ্যে আলম খান মেজো। বাংলাদেশের প্রখ্যাত পপসঙ্গীত শিল্পী আজম খান ছিলেন তাঁর ছোট ভাই।

আলম খান এর জন্মের পর তাঁর বাবার চাকরি সুবাদে তাদের পরিবার কলকাতায় চলে যান। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর আবার তাঁরা ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকাতেই স্থায়ী হয় তাদের পরিবার এবং সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে ভর্তি হন আলম খান। এই স্কুল থেকেই মেট্রিক পাস করেন। স্কুলে পড়াকালীন সময়েই গানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয় আলম খান এর। মায়ের উৎসাহে গানের চর্চা চালিয়ে যান। পরবর্তীতে ওস্তাদ ননী চ্যাটার্জীর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেন।

১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘তালাশ’ চলচ্চিত্রে, খ্যাতিমান সঙ্গীত পরিচালক রবিন ঘোষের সহকারী হিসেবে প্রথম কাজ করেন আলম খান। পরবর্তিতে আলতাফ মাহমুদ, খান আতা ও খোন্দকার নুরুল আলমের সাথেও সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৬৫ সালের দিকে ‘ভাড়াটে বাড়ি’ ও ‘মহুয়া’ নামে দু’টি মঞ্চনাটকের সঙ্গীত পরিচালনা করেন আলম খান। ১৯৬৭ সালে টেলিভিশনে একটি শিশুতোষ অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনা করেন। চলচ্চিত্রকার আব্দুল জব্বার খান পরিচালিত ‘কাঁচ কাটা হীরে’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এককভাবে সঙ্গীত পরিচালনা শুরু করেন, ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে। আলম খান সুরারোপিত ও সঙ্গীত পরিচালিত চলচ্চিত্রসমূহ- কাঁচ কাটা হীরে, স্মৃতিটুকু থাক, শ্লোগান, পায়ে চলার পথ, খেলাঘর, আমার জন্মভূমি, অন্তরালে, লাভ ইন সিমলা, সুপ্রভাত, কি যে করি, গুন্ডা, দুস্ত দুশমন, সারেং বৌ, রাজদুলারী, আসামী হাজির, আরাধনা, আগুনের আলো, মিন্টু আমার নাম, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, মাটির পুতুল, বাঁধনহারা, সোনার চেয়ে দামী, মহেশখালীর বাঁকে, ঘরজামাই, কন্যাবদল, জবাব, বারুদ, বন্দুক, ছোট মা, সখি তুমি কার, কথা দিলাম, হুর-এ আরব, যাদুনগর, প্রতিজ্ঞা, রজনীগন্ধা, বড় ভালো লোক ছিল, নাতবৌ, সি আই ডি, নাগ পূর্ণিমা, তিন কন্যা, মৎসকুমারী, শরীফ বদমাশ, শাহী কানুন, প্রান সজনী, প্রতিহিংসা, মানসম্মান, চ্যালেঞ্জ, জনি, অন্যায়, সোহেল রানা, লড়াকু, আওয়ারা, অশান্তি, হাইজ্যাক, সারেন্ডার, গৃহবিবাদ, লালু মাস্তান, দুই জীবন, বীর পুরুষ, ভেজা চোখ, বোনের মত বোন, ভাইজান, বজ্রমুষ্টি, ভাই ভাই, অচেনা, সান্ত্বনা, ত্যাগ, বেপরোয়া, সত্য মিথ্যা, চোরের বউ, কেয়ামত থেকে কেয়ামত, ঘৃণা, কমান্ডার, অন্তরে অন্তরে, স্বপ্নের ঠিকানা, বিশ্বপ্রেমিক, সন্ত্রাস, এই ঘর এই সংসার, প্রিয়জন, বিচার হবে, কুলি, ভন্ড, অনন্ত ভালবাসা, ম্যাডাম ফুলি, মেজর সাহেব, মাস্তানের উপর মাস্তান, টপ সম্রাট, চাচ্চু, কি যাদু করিলা, এবাদত, কাজের মানুষ, হায় প্রেম হায় ভালোবাসা, মায়ের চোখ, আমার স্বপ্ন আমার সংসার, কে আপন কে পর, শবনম, প্রভৃতি।

আমাদের বাংলা গানের অনন্য সুরশ্রষ্টা আলম খান সুরারোপিত জনপ্রিয় ও কালজয়ী গানগুলোর মধ্যে- ‘তবলার তেড়ে কেটে তাক’, ‘চুমকি চলেছে একা পথে’, ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘হীরামতি হীরামতি ও হীরামতি’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো’, ‘তিন কন্যা এক ছবি’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘কি জাদু করিলা পীরিতি শিখাইলা’, ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’, ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা’, ‘আমি একদিন তোমায় না দেখিলে’, ‘সাথীরে যেও না কখনো দূরে’, ‘বুকে আছে মন মনে আছে আশা’, ‘ভালবেসে গেলাম শুধু ভালবাসা পেলাম না’, ‘আজকে না হয় ভালবাসো আর কোনদিন নয়’, ‘আমি তোমার বধূ তুমি আমার স্বামী’, ‘মনে বড় আশা ছিল তোমাকে শোনাবো গান’, ‘দুনিয়াটা মস্ত বড় খাওদাও ফূর্তি করো’, ‘কাল তো ছিলাম ভাল আজ আমার কি হলো’, ‘ভালবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া’, ‘আকাশেতে লক্ষ তারা চাঁদ কিন্তু একটাইরে’, ‘শহর থেকে অনেক দূরে চলেছি’, ‘কি সুখ পাও তুমি’, ‘হেরে গেছি আজ আমি নিজের কাছে’,
‘শোন গো রূপসী ললনা’, ‘আমার প্রেমের তরী’, ‘তুমি আছো সবই আছে’, ‘মানুষ নিষ্পাপ পৃথিবীতে আসে’, ‘তেল গেলে ফুরাইয়া বাত্তি যায় নিভিয়া’…অন্যতম।

আলম খান তাঁর কাজের অস্বীকৃতি হিসেবে একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। যারমধ্যে আছে-
শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক- বড় ভালো লোক ছিল (১৯৮২), শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক- তিন কন্যা (১৯৮৫), শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক- সারেন্ডার (১৯৮৭), শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক- দিনকাল (১৯৯২), শ্রেষ্ঠ সুরকার- বাঘের থাবা (১৯৯৯), শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক- এবাদত (২০০৯), শ্রেষ্ঠ সুরকার- কি যাদু করিলা (২০১০)। এছাড়াও পেয়েছেন বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার, চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি পুরস্কার এবং বিভিন্ন সংগঠন থেকে নানা পুরস্কার ও সম্মাননা।

আলম খান ১৯৭৬ সালে, হাবিবুননেসা গুলবানুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। গুলবানু একজন গীতিকার। আলম খানের সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া “তুমি তো এখন আমারই কথা ভাবছো” এই গানটির গীতিকার গুলবানু। তাদের দুই ছেলে আরমান খান ও আদনান খান, দুজনেই সঙ্গীত পরিচালক এবং একমাত্র মেয়ে আনিকা খান।

বাংলাদেশের সেরা সংগীত পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন আলম খান। চলচ্চিত্রের গান ছাড়াও ফোক, রক্ ও আধুনিক সব ধরণের গানই করেছেন তিনি। গীটার, কীবোর্ড, পিয়ানো ও বেহালা এসব বাদ্যযন্ত্র বাজানোতেও ছিলেন বেশ পারদর্শী।

চলচ্চিত্রে কাজ করার শুরু থেকে, ধারাবাহিক সাফল্যের মধ্য দিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন একের পর এক জনপ্রিয় সব গান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গানে তাঁর অবস্থান জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তাঁর শ্রুতিমধুর সুরের মূর্ছনায় এই দেশের আপামর শ্রোতাদের বিমোহিত করেছেন, উদ্বেলিত করেছেন যুগের পর যুগ ধরে। তাঁর সুর করা চলচ্চিত্রের গান ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ও সমাদৃত হয়েছে সর্বস্তরে।

কয়েক দশক ধরে অসংখ্য সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনার মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সঙ্গীতের কিংবদন্তী।

উপমহাদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী কুমার শানুকে প্রথম চলচ্চিত্রে (বাংলাদেশের ছবি-তিনকন্যা’তে) গান গাওয়ার সুযোগ করে দেন আমাদের সংগীতের স্বর্ণসন্তান আলম খান। তিনি আমাদের দেশের অনেক কণ্ঠশিল্পীকেই চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার প্রথম সুযোগ করে দিয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় করে তুলেছেন।

চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি বেতার ও টেলিভিশনের জন্যও অসংখ্য গানে সুর করেছেন আলম খান। সেসব গানও পেয়েছে জনপ্রিয়তা।

বর্ণাঢ্য সংগীতজীবনে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গানকে করেছেন বর্ণিলময়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে জনপ্রিয় ও কালজয়ীসব গানে সমৃদ্ধ করে যাওয়া বিস্ময়কর সুরশ্রষ্টা, বাংলাদেশের সঙ্গীতের মহিরূহ ব্যক্তিত্ব আলম খান শারীরিকভাবে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু বেঁচে আছে তাঁর সৃষ্টি, আছে তাঁর শ্রুতিমধুর সুর করা হাজারো গান, যা থাকবে অনন্তকাল। তাঁর এই গানের মোহনীয় সুরের মূর্ছনার মধ্যদিয়ে অনাদিকাল বেচেঁ থাকবেন- বাংলা গানের বিস্ময়কর সুরশ্রষ্টা আলম খান।

Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন