এ কে আজাদ: আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। গীতিকবি-সুরকার, সঙ্গীতপরিচালক-কন্ঠশিল্পী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে কিশোর বয়সেই চলে গিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীনের পর লেখাপড়া করার পাশাপাশি গিটার হাতে অধিষ্ঠিত হন বাংলাদেশের সঙ্গীতের মঞ্চে। এক সময় বাংলাদেশের সঙ্গীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। দেশপ্রেমের চেতনা বুকে ধারণ করে, সৃষ্টি করেন অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান। বাংলা ও বাঙালির চেতনা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে তাঁর সুর ও বাণীতে। জাতীর গৌরব ও অহংকারে পরিণত হন মেধাবী এই সুরস্রষ্টা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অসংখ্য অসংখ্য জনপ্রিয় সুপারহিট গানের গীতিকবি ও সুরকার তিনি। বাংলাদেশের সঙ্গীতজগতের অসম্ভব প্রতিভাবান মেধাবী গুণি ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।
বাংলা গানে শ্রুতিমধুর সুরের যাদুকর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারী, ৬৩ বছর বয়সে, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুদিবসে প্রয়াত এই সঙ্গীতজ্ঞ’র স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি, ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। পৈতিৃক নিবাস নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার আটিয়াকান্দী গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ওয়াফিজ আহমেদ ও মাতার নাম ইফাদ আরা নাজিমুন নেসা। ঢাকার আজিমপুরের ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন এবং জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
ছাত্রজীবনে মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত অবস্থায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৭৬ সাল থেকে নিয়মিত গান-বাজনা শুরু করেন।
তাঁর সংগীত পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘নাগরদোলা’ ১৯৭৯ সালে মুক্তি পায়। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল-এর সুর ও সংগীত পরিচালনার অন্যান্য ছবিগুলো- মেঘ বিজলী বাদল, আঁখি মিলন, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, নয়নের আলো, পাতাল বিজয়, মোহাম্মদ আলী, রঙিন রাখাল বন্ধু, রঙিন জরিনা সুন্দরী, স্বর্গনরক, সৎ ভাই, দায়ী কে, যন্ত্রণা, পাগলি, মরনের পরে, জীবন ধারা, সহযাত্রী, লোভ লালসা, ছেলে কার, অবুঝ হৃদয়, মায়ের অধিকার, চাওয়া থেকে পাওয়া, বিয়ের ফুল, তেজি, দাঙ্গা, আম্মাজান, আব্বাজান, লুটতরাজ, অবুঝ হৃদয়, মহৎ, তুমি বড় ভাগ্যবতী, হিংসা, লাভ স্টোরি, দেশ প্রেমিক (সুরকার আজাদ রহমানের সাথে যৌথ) জখম, আন্দোলন, বাঘিনী কন্যা, ক্রিমিনাল, বন্ধন, মুক্তি চাই, প্রেমের তাজমহল, প্রেমের জ্বালা, অন্ধ প্রেম, বর্তমান, মিনিস্টার, ইতিহাস, জ্যোতি, সাক্ষী-প্রমাণ, লক্ষ্মীর সংসার, মায়ের সম্মান, অন্যায়ের প্রতিবাদ, অশান্ত আগুন, কষ্ট, রাঙা বউ, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, পরেনা চোখের পলক, তোমাকে চাই, ভুলনা আমায়, জ্বলন্ত বিস্ফোরণ, তাণ্ডব লীলা, সমাজ কে বদলে দাও, জবর দখল, ধর, আজ গায়ে হলুদ, লাভ ইন থাইল্যান্ড, অন্ধকার, কাল নাগিনীর প্রেম, মন মানে না, মন, ক্রোধ, লুটপাট, নারীর মন, সিপাহী, দুনিয়া, ক্ষত বিক্ষত, বলনা ভালবাসি, সাথি তুমি কার, সতিপুত্র আবদুল্লাহ, আমার জান, হুলিয়া, প্রেম কেন কাঁদায়, অনেক দিনের আশা, নিষিদ্ধ নারী, ফুল নেব না অশ্রু নেব, আনন্দ অশ্রু, অন্ধ ভালবাসা, অবুঝ দুটি মন, শাসন, মহড়া, মা যখন বিচারক, তুমি আমারি, আত্ম-অহংকার, আমার অন্তরে তুমি, বিক্ষোভ, পানজা, সুখের ঘরে দুঃখের আগুন, সাবধান, মহা মিলন, কাজের মেয়ে, ধাওয়া, দুই নয়নের আলো, বিদ্রোহ চারিদিকে, বিয়ের ফুল, মাটির ফুল, দুশমন দরদী, হিম্মত, ইতিহাস, মুখোমুখি, গনদুশমন, প্রেমের জ্বালা, নাটের গুরু, অন্যায়ের প্রতিশোধ, ঢাকাইয়া মাস্তান, বিদ্রোহী সন্তান, ভালোবাসি তোমাকে, মাতৃভূমি, না বলো না, জন্মশত্রু, ভালবাসার শত্রু, কপাল, ভালোবাসা ভালোবাসা, কাবিননামা, কঠিন প্রেম, এরই নাম ভালোবাসা, ছোট বোন, মা আমার স্বর্গ, মা আমার বেহেশত, অবুঝ শিশু, সন্তান আমার অহংকার, মিয়া বাড়ির চাকর, অঙ্ক, গুরুভাই (অভিনয়ও করেন), মাটির ঠিকানা, আমার পৃথিবী তুমি (যৌথ), রাজা সূর্য খাঁ (যৌথ), প্রভৃতি।
অসংখ্য জনপ্রিয় গানে সুর করেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, যার অধিকাংশ গানই নিজের লেখা। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি জনপ্রিয় গানের মধ্যে- সব ক’টা জানালা খুলে দাও না…, ও মাঝি নাও ছাইড়া দে, ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে…, সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পারে দাঁড়িয়ে…, মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেব না…., আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি…., আমার বুকের মধ্যেখানে….., আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনে ছিলাম গান…, আমি তোমারি প্রেমও ভিখারি….., আমার মন কান্দে, ও আমার প্রাণ কান্দে…., আইল দারুণ ফাগুন রে…., আমি তোমার দুটি চোখে দুটি তারা হয়ে থাকব…., আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে….., পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমারই ছোঁয়াতে যেন পেয়েছি…., তোমায় দেখলে মনে হয় হাজার বছর আগেও বুঝি ছিল পরিচয়…, বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম…, আম্মাজান আম্মাজান….., এই বুকে বইছে যমুনা….., পৃথিবীর জন্ম যেদিন থেকে তোমার আমার প্রেম সেদিন থেকে…, পড়ে না চোখের পলক…., যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে…., অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে…., তুমি আমার জীবন আমি তোমার জীবন…., তোমার আমার প্রেম এক জনমের নয়…., আমার হৃদয় একটা আয়না….., তুমি মোর জীবনের ভাবনা হৃদয়ে সুখের দোলা…, তুমি আমার এমনই একজন যারে এক জনমে ভালবেসে ভরবে না এ মন…., একাত্তরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তিসেনার দল…, বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয় এখানে সভ্যতারই ফুল ফোটানো হয়…, অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন…, চিঠি লিখেছে বউ আমার ভাঙা ভাঙা হাতে…, অন্যতম।
এই কৃতিমান সঙ্গীতজ্ঞ তাঁর কাজের স্বিকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার: শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক-২০০১ (প্রেমের তাজমহল), শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক-২০০৫ (হাজার বছর ধরে)। বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার: সেরা গীতিকার – ১৯৮৪ (নয়নের আলো), সেরা গীতিকার-১৯৯৯ (আম্মাজান), সেরা গীতিকার-২০০১ (আব্বাজান), সেরা গীতিকার-২০০২ (ইতিহাস), সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস-সেরা সঙ্গীত পরিচালক (২০০৪)।
সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদক-২০১০ প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশের সেরা সংগীত পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম একজন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। বলা যায় সবচেয়ে জনপ্রিয় সুরকার ও সংগীত পরিচালক তিনি। তাঁর সুরের মূর্ছনায় এই দেশের আপামর শ্রোতাদের বিমোহিত করেছেন, উদ্বেলিত করেছেন যুগের পর যুগ ধরে। তাঁর লেখা/সুর করা দেশাত্মবোধক, আধুনিক এবং চলচ্চিত্রের গান ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ও সমাদৃত হয়েছে সর্বস্তরে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গানে তাঁর অবস্থান জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
বাংলা গানে শ্রুতিমধুর সুরের যাদুকর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, বড়ো অসময়ে চলে গেছেন অনন্তলোকে। রেখে গেছেন তাঁর লেখা ও সুর করা কালোত্তীর্ণ সব গান। সেসব গানের মাধ্যমে, লাখো-কোটি ভক্তের ‘…বুকের মধ্যেখানে..’ তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।