English

16 C
Dhaka
সোমবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪
- Advertisement -

নাজির আহমেদ: আমাদের দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের অগ্রপথিক

- Advertisements -

আজাদ আবুল কাশেম: আমাদের দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের অগ্রপথিক, বিশিষ্ট শিল্প-সাংস্কৃতিকব্যক্তিত্ব নাজির আহমেদ-এর ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৯০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। প্রয়াত এই চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

নাজির আহমেদ ১৯২৫ সালে, পুরান ঢাকার ইসলামপুরে, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দাদা মির্জা হায়াৎ নবাববাড়িতে প্রদর্শিত নাটকসমূহে অভিনয় করতেন। তাঁর বাবা মির্জা ফকিরও ছিলেন অভিনেতা, মায়ের নাম জামিলা খাতুন। তাঁর চাচা ঢাকার শেষ বাইশ পঞ্চায়েতের নেতা মির্জা আবদুল কাদের সর্দার, যিনি নাটক-গান ও চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত ছিলেন। ইসলামপুরে ‘ডায়মন্ড থিয়েটার’ ক্রয় করে প্রথমে ‘লায়ন থিয়েটার’ নামে চলচ্চিত্র প্রদর্শন ব্যবসা শুরু করেন, পরে নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘লায়ন সিনেমা’। নাজির আহমেদের বড় ভাই আবু নাসের আহমেদ ছিলেন পূর্ব বাংলা চলচ্চিত্র সংস্থার একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর ছোট ভাই হামিদুর রহমান একজন চিত্রশিল্পী, যিনি শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। সর্বকনিষ্ঠ সাঈদ আহমদ ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ও লেখক।

নাজির আহমেদ ৪ বছর বয়সে ঢাকার হামিদিয়া মাদ্রাসায় শিশু শ্রেণিতে ভর্তির মাধ্যমে একাডেমিক শিক্ষা শুরু করেন। তৃতীয় শ্রেণি থেকে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে লেখাপড়া করেন এবং ১৯৩৮ সালে এই স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৪২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি পাস করেন নাজির আহমেদ। ছাত্রাবস্থায় ঢাকা হল, জগন্নাথ হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, কার্জন হল, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ ও নরসিংদীসহ বিভিন্ন স্থানে নাটক করতেন। সে সময়ে নাটকে অভিন করে সেরা অভিনেতা হিসেবে স্বর্ণপদকও পেযেছেন তিনি।

১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর, নাজিম উদ্দিন রোডে ‘ঢাকা রেডিও সম্প্রচার মাধ্যম’ (ঢাকা ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র) সৃষ্টি হলে, তিনি ছাত্র থাকা অবস্থায়ই সেখানে যোগ দেন। ১৯৪২ সালের শেষ দিকে যোগ দেন ‘কোলকাতা আকাশ বাণী’তে ঘোষক হিসেবে । ঘোষক ছাড়াও তিনি ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় চলচ্চিত্র ইউনিট, তথ্যচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রের ধারা বিবরণীতে কণ্ঠ দিতেন। পরবর্তিতে কলকাতা ছেড়ে পুনরায় চলে আসেন ‘ঢাকা ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্রে’। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ‘ঢাকা ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র’ নাম পরিবর্তন করে ‘পাকিস্তান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’ নামে চালু হয়।

ঢাকায় নির্মিত প্রথম সবাক প্রামাণ্যচিত্র ‘ইন আওয়ার মিডস্ট’-এর নির্মাতা নাজির আহমেদ। প্রামাণ্যচিত্রটি পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র দশ দিনের ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে নির্মিত। স্টুডিও, ল্যাব ও ক্যামেরা বিহিন প্রতিকূল পরিবেশে কোলকাতা থেকে ক্যামেরা ও চিত্রগ্রাহক এনে নির্মিত ও কোলকাতার অরোরা স্টুডিও নির্মিত তথ্যচিত্রটি ১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট মুক্তি পায়।

নাজির আহমেদ ১৯৪৯ সালে বিবিসিতে যোগদান করে বাংলা বিভাগ চালু করেন। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বিবিসিতে কর্মরত ছিলেন তিনি। লন্ডনে থাকা অবস্থায় ব্রিটিশ মুভিটোন স্টুডিওতে নিয়মিত যেতেন এবং চলচ্চিত্র ও ডকুমেন্টারি নির্মাণের কলাকৌশল শিখতেন।

১৯৫৪ সালে নাজির আহমেদ তাঁর নিজের কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য, পরিচালনা ও সম্পাদনায় ‘সালামত’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন- ক্যামেরা লন্ডন থেকে এবং ক্যামেরাম্যান লাহোর থেকে আসলেও শুটিং পরবর্তী কাজ করা হয় কোলকাতায়।

পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৫৫ সালের ১৯ জুন প্রতিষ্টিত পূর্ববঙ্গ সরকারের জনসংযোগ বিভাগে চলচ্চিত্র ইউনিটে পরিচালক পদে যোগ দেন। এরপর তিনি ‘চাকা’ ও ‘১৯৫৫’ নামে আরো দুটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন।

১৯৫৭ সালে তাঁরই উদ্দ্যোগে তৎকালীন শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এফডিসি বিল উত্থাপন করেন। নাজির আহমেদ সেসময় থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’র (পরবর্তীতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন) প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

নাজির আহমেদ ১৯৬২ সালে লন্ডন চলে গেলেও ১৯৬৮ সালে তাঁর পরিচালিত একমাত্র পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘নতুন দিগন্ত’ মুক্তি পায়।
বহু প্রতিভাধর অসাধারণ গুণের অধিকারী সাংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব নাজির আহমেদ, প্রায় ৫০টির মতো বেতার নাটক লিখেছেন। এফডিসিতে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আসিয়া’র কাহিনী ও সংলাপ লিখেছেন তিনি। প্রামাণ্যচিত্র ‘নবারুণ’সহ অনেক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন।

এফডিসি প্রতিষ্ঠার পিছনে তাঁর রয়েছে অসামান্য অবদান। তিনি এফডিসি’র পরিচালক হয়ে, এদেশের বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্বদের চলচ্চিত্রশিল্পের সাথে জড়িত হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা যোগান এবং সব রকমের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে দেন। এদেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে বৈজ্ঞানিক পন্থায় প্রতিষ্ঠা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রহণ করেন বাস্তব ও কার্যকর সব ব্যবস্থা। এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশের তুলনায় স্বয়ংসম্পূর্ণ উন্নত মানের চলচ্চিত্র নির্মানের জন্য স্টুডিও তৈরি করেন তিনি। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, কলা-কুশলী, কাহিনিকার, চিত্রগ্রাহক ও পরিচালকের আগমনে মুখরিত হয় আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প। নির্মাণ হয় ক্লাসিক, লোককাহিনি, সামাজিক ও সাহিত্য নির্ভর কালজয়ী সব চলচ্চিত্র।

একজন কবি, গীতিকার, কাহিনীকার, নাট্যকার, অভিনেতা, বেতার অনুষ্ঠান ঘোষক, সংগঠক, চলচ্চিত্র পরিচালক -প্রযোজক ও একজন শিল্প-সংস্কৃতিবান্ধব প্রশাসক ছিলেন নাজির আহমেদ। তাদের পুরো পরিবার ছিল পুরান ঢাকার শিল্প, সাহিত্য, রাজনৈতিক ও সংস্কৃতি ঘরানার। আমাদের দেশের শিল্প-সংস্কৃতিতে, তাঁর এবং তাঁর পরিবারের রয়েছে অসামান্য অবদান। আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের অগ্রপথিক হিসেবে নাজির আহমেদ-এর নাম, ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন