আজাদ আবুল কাশেম: দেশবরেণ্য সাহিত্যিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ-এর দশম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০১২ সালের ১৯ জুলাই, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে নিউ ইয়র্কের বেলেভ্যু হাসপাতালে, মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। এই গুণি ব্যক্তিত্বের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর, নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জে, তাঁর মাতামহের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা ফয়েজ। তাঁর অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশের একজন শিক্ষাবিদ এবং কথাসাহিত্যিক, আরেক ভাই আহসান হাবীব রম্য সাহিত্যিক এবং কার্টুনিস্ট। তাঁর তিন বোন হলেন সুফিয়া হায়দার, মমতাজ শহিদ, ও রোকসানা আহমেদ।
তাঁর রচিত আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে, ছোটকালে হুমায়ূন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান, ডাকনাম কাজল। তাঁর পিতা (ফয়জুর রহমান) নিজের নামের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রাখেন শামসুর রহমান। পরবর্তীতে আবার তিনি নিজেই ছেলের নাম পরিবর্তন করে হুমায়ূন আহমেদ রাখেন।
হুমায়ূন আহমেদ ‘বগুড়া জিলা স্কুল’ থেকে ১৯৬৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন (রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন) । তিনি পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি’ থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে, পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৭৩ সালে, ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে যোগদান করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে লেখালেখি এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বার্থে অধ্যাপনা ছেড়ে দেন।
হুমায়ূন আহমেদ স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন বই পড়ার পাশাপাশি জাদু’র প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরেন এবং বিভিন্ন জনের কাছ থেকে জাদু শিখতে থাকেন। কলেজে পড়াকালীন সময়ে তিনি জাদুবিদ্যার প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে পরেন। বিভিন্ন জাদুকরের কাছ থেকে জাদু শিখেন এবং জাদুর সরঞ্জামাদি কেনেন। বন্ধুুমহলে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি নিজেও জাদু প্রদর্শন করেন এবং যাদুশিল্পী হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তোলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে যাদুশিল্পী হিসেবে তাঁর নাম-ডাক ছড়িয়ে পরে। ১৯৬৮ সালে তিনি প্রথম টিভিতে (তৎকালীন পিটিভি) জাদু প্রদর্শন করেন। জনপ্রিয় লেখক হওয়ার আগেই তিনি ছিলেন জনপ্রিয় যাদুশিল্পী। ‘যাদুশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ’ এই নামে তাঁকে নিয়ে একটি বইও লেখা হয়েছে, লিখেছেন আরেক যাদুশিল্পী এম এ জলিল। হুমায়ূন আহমেদ ভালো ছবিও আঁকতেন।
হুমায়ূন আহমেদ রচিত প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে । তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাসসমূহর মধ্যে- শঙ্খনীল কারাগার, তোমাদের জন্য ভালোবাসা, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, শ্যামল ছায়া, মধ্যাহ্ন, মাতাল হাওয়া, লীলাবতী, কবি, বাদশাহ নামদার, নিশীথিনী, ময়ূরাক্ষী, নিষাদ, অন্য ভুবন, বৃহন্নলা, দেবী, আমার আছে জল, দারুচিনি দ্বীপ, প্রিয়তমেষু, নিরন্তর, সাজঘর, সম্রাট, আকাশ জোড়া মেঘ, দ্বৈরথ, এইসব দিনরাত্রি, অয়োময়, বহুব্রীহি, নীল অপরাজিতা, কোথাও কেউ নেই, পাখি আমার একলা পাখি, জলপদ্ম, আয়নাঘর, কৃষ্ণপক্ষ, জনম জনম, তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে, জল জোছনা, তিথির নীল তোয়ালে, ছায়াবীথি, যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ, গৌরীপুর জংশন, পেন্সিলে আঁকা পরী, কবি, জলকন্যা, দূরে কোথায়, রুমালী, মেঘ বলেছে যাব যাব, কালো যাদুকর, রূপার পালঙ্ক, বৃষ্টি বিলাস, নীল মানুষ, আসমানীরা তিন বোন, অচিনপুর, আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি, রোদনভরা এ বসন্ত, নক্ষত্রের রাত, এই বসন্তে, অমানুষ, নির্বাসন, সবাই গেছে বনে, মাতাল হাওয়া, রূপা, ম্যাজিক মুনশি, মেঘের ওপর বাড়ি, আগুনের পরশমণি, দেয়াল, হিমু, মিসির আলী, জোছনা ও জননীর গল্প, ইত্যাদি অন্যতম ।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় তিন শতাধিক। এরমধ্যে বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদ এক সময় টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখতে থাকেন এবং পরবর্তিতে নাটক নির্মাণ শুরু করেন।টেলিভিশনের জন্য তাঁর প্রথম নাটকের নাম ‘প্রথম প্রহর’, এটি ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়, নাটকটি পরিচালনা করেন নওয়াজিশ আলি খান। তাঁর লেখা ও নির্মাণ করা নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- অসময়, অযাত্রা, বিবাহ, এসো নিপবনে, নিমফুল, এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়, আজ রবিবার, খেলা, অচিন বৃক্ষ, খাদক, একি কান্ড, একদিন হঠাৎ, অন্যভুবন, হাবলঙ্গের বাজার, অনাথ বাবুর ভয়, বৃক্ষমানব, শওকত সাহেবের গাড়ি কেনা, চন্দ্র কারিগর, গণি সাহেবের শেষ কিছু দিন, লীলাবতী, জুতা বাবা, আজ জড়ির বিয়ে, খোয়াব নগর, পিশাচ মকবুল, জলতরঙ্গ, এই বর্ষায়, জিন্দা কবর, তাঁরা তিনজন, ২৪ ক্যারাট ম্যান, উড়ে যায় বকপক্ষী, কালা কইতর, সেদিন চৈত্রমাস, নক্ষত্রের রাত, অচিন রাগিনী, রুপালী রাত্রি, ওপেনটি বায়োস্কোপ, ইবলিশ, আগুন মজিদ, এই বর্ষায়, নগরে দৈত্য, হিমু, রুপা, লীলাবতীর মৃত্যু, যমুনার জল দেখতে কালো, জলে ভাসা পদ্ম, তিন প্রহর, মায়াবতী, খোয়াব নগর, চোর, প্রভৃতি।
হুমায়ূন আহমেদের সব নাটকই তুমুল দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর কিছু কিছু নাটকতো জনপ্রিয়তার চরম শীর্ষে ছিল, যা টেলিভিশন নাটকের জগতে ইতিহাস হয়ে আছে।
হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। তাঁর নির্মিত প্রথম
চলচ্চিত্রই, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র’সহ আটটি বিভাগে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ লাভ করে। তাঁর নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলো হলো- শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, শ্যামল ছায়া, চন্দ্রকথা, আমার আছে জল, নয় নম্বর বিপদ সংকেত ও ঘেটু পুত্র কমলা । এরমধ্যে-‘শ্যামল ছায়া’ ও ‘ঘেটু পুত্র কমলা’ চলচ্চিত্র দুটি বাংলাদেশ থেকে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কারের জন্য দাখিল করা হয়েছিল।
তাঁর নির্মিত সবগুলো চলচ্চিত্রই জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং সূধীমহল কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে অনেক পরিচালকই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন এবং পুরস্কারও পেয়েছেন। এরমধ্যে- মোস্তাফিজুর রহমান নির্মাণ করেন ‘শঙ্খনীল কারাগার’, তৌকির আহমেদ নির্মাণ করেন ‘দারুচিনি দ্বীপ’, মোরশেদুল ইসলাম তৈরী করেন ‘দূরত্ব’, ‘প্রিয়তমেষু’ ও ‘অনিল বাগচীর একদিন’, বেলাল আহমেদ ‘নন্দিত নরকে’, আবু সাইয়ীদ পরিচালিত ‘নিরন্তর’, শাহ আলম কিরণ নির্মাণ করেন ‘সাজঘর’, মেহের আফরোজ শাওন পরিচালিত ‘কৃষ্ণপক্ষ’, অনম বিশ্বাস পরিচালনা করেন ‘দেবী’ ।
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলা কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৩ সালে লেখক শিবির পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা উপন্যাসে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান, এছাড়া তিনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে, মাইকেল মধুসুদন পদক লাভ করেন। ১৯৯০ সালে, হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার পান, তিনি জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক লাভ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৯৪ সালে দেশের দ্বিতীয় বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।
১৯৯২ সালে ‘শঙ্খনীল কারাগার’ চলচ্চিত্রের জন্য, শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে তিনি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। একই বছরে ‘আগুনের পরশমণি’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা বিভাগে তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০০৭ সালে ‘দারুচিনি দ্বীপ’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১২ সালে ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক এবং শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০১২ সালে ‘অনিল বাগচীর একদিন’ চলচ্চিত্রের জন্য, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতার পুরস্কার (মরণোত্তর) পান । এছাড়াও বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার’সহ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।
জাপান টেলিভিশন NHK হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে ১৫ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করেছে, Who is who in Asia শিরোনামে ।
ব্যাক্তিজীবনে হুমায়ূন আহমেদ ১৯৭৩ সালে, গুলতেকিন খান-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির তিন মেয়ে এবং এক ছেলে। বড় মেয়ে নোভা আহমেদ, মেজো মেয়ে শীলা আহমেদ এবং ছোট মেয়ে বিপাশা আহমেদ। তাঁর বড় ছেলের নাম নুহাশ হুমায়ুন। রাশেদ হুমায়ূন নামে অন্য আরেকটি ছেলে সন্তান অকালে মারা যায়। ২০০৫-এ গুলতেকিনের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয় এবং ঐ বছরই অভিনেত্রী শাওনকে বিয়ে করেন। এ ঘরে তাদের তিন ছেলে-মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রথম ভূমিষ্ঠ কন্যটি মারা যায়, যার নাম ছিলো লীলাবতী, আর ছেলে দু’জনের নাম নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ুন।
হুমায়ুন আহমেদ। একজন ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, যাদুশিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক-প্রযোজক । বাংলাদেশের সাহিত্যভুবনে প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব তিনি । জনপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী লেখক। তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস পেয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা, তরুণপাঠক সৃষ্টিতে রেখেছে অনন্য অবদান।
তাঁর সৃষ্ট ‘হিমু’ এবং ‘মিসির আলি’ চরিত্রগুলো বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদেরকে গভীরভাবে বিমোহিত করেছে, উদ্বেলিত করেছে। বাংলাদেশের সাহিত্যাকাশে সর্বাধিক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হুমায়ুন আহমেদ।