দেবদাসখ্যাত সুঅভিনেতা বুলবুল আহমেদ-এর ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ । তিনি ২০১০ সালের ১৫ জুলাই, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। অসাধারণ গুণি এই অভিনেতার স্মৃতির প্রতি বিন্ম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
বুলবুল আহমেদ ১৯৪১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, পুরান ঢাকার আগামসি লেনে, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম তাবারক আহমেদ, পিতামাতা তাঁকে ‘বুলবুল’ বলে ডাকতেন। পিতা খলিল আহমেদ ছিলেন, পাকিস্তান আমলের অর্থ বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি এবং অভিনেতা-নাট্যকার। মায়ের নাম মোসাম্মত মোসলেমা বেগম। অনেক সময় তাদের বাড়িতে নাটকের মহড়া হত। কিশোর বুলবুল প্রায়ই সেই মহড়া দেখতেন। ঢাকার ফুলবাড়িয়ার মাহবুব আলি ইনস্টিটিউশনে তাঁর বাবার নির্দেশিত নাটক মঞ্চস্থ হলে, তিনিও দেখতে যেতেন। সেখান থেকেই তার অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ জন্ম নেয়।
বুলবুল আহমেদ ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৫৭ সালে, ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে, আই.এ পাস করেন। নটরডেম কলেজ থেকে ১৯৬১ সালে, বি.এ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগ থেকে ১৯৬৩-তে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বার্ষিক নাটকে অভিনয় করতেন তিনি, এক সময় গ্রুপ থিয়েটার ড্রামা সার্কেল নাট্যগোষ্ঠির স্বক্রিয় সদস্য হয়ে যান।
পড়া-লেখা শেষ করে বুলবুল আহমেদ, তৎকালীন ইউবিএল ব্যাংক-এ চাকুরী নেন। ইউবিএল ব্যাংক-এর টিএসসি শাখার ম্যানেজার ছিলেন তিনি। চাকরির পাশাপাশি মঞ্চ ও টিভি নাটকে অভিনয় করতেন।
টেলিভিশনে বুলবুল আহমেদ অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটক- বরফ গলা নদী, মালঞ্চ, ইডিয়েট, মাল্যদান, বড় দিদি, আরেক ফাল্গুন, শেষ বিকেলের মেয়ে, দক্ষিণের জানালা, তোমাদের জন্য ভালোবাসা, তুমি রবে নীরবে, টাকায় কি না হয়, হৈমন্তী, দূরদর্শিনী, সারাদিন বৃষ্টি, এই সব দিনরাত্রি, প্রভৃতি।
বুলবুল আহমেদ ‘ইয়ে করে বিয়ে’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পদার্পণ করেন। ইউসুফ জহির পরিচালিত ছবিটি মুক্তিপায় ১৯৭৩ সালে। তাঁর অভিনীত অন্যান্য ছবিসমূহের মধ্যে আছে- অঙ্গীকার, রূপালী সৈকতে, মনের মানুষ, অঙ্গার, সীমানা পেরিয়ে, সূর্য কন্যা, জননী, যাদুর বাঁশি, বধূ বিদায়, জন্ম থেকে জ্বলছি, ওয়াদা, দেবদাস, মহানায়ক, ভালো মানুষ, যৌতুক, সোনার হরিণ, দি ফাদার, আরাধনা, শেষ উত্তর, গাংচিল, সোনার তরী, কলমিলতা, কালো গোলাপ, সাক্ষী, আল্লাহ মেহেরবান, পুরস্কার, সময় কথা বলে, ফেরারী বসন্ত, সোহাগ, বৌরাণী, ঘর সংসার, ডার্লিং, শক্তিশালী, ছোট মা, জীবন নিয়ে জুয়া, সঙ্গিনী, স্মৃতি তুমি বেদনা, স্বামী, বদনাম, পেনশন, দহন, শত্রু, মা ও ছেলে, শুভদা, মায়ের দাবী, লাভ ইন আমেরিকা, সারেন্ডার, নওজোয়ান, ঝিনুকমালা, রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত, দুই জীবন, রঙ্গীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, ত্রাস, বিক্ষোভ, এই ঘর এই সংসার, দিপু নাম্বার টু, মৌমাছি, আকর্ষণ, গরম হাওয়া, কত যে আপন, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, এখনো অনেক রাত, শ্বশুরবাড়ী জিন্দাবাদ, নিঃশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি, সুন্দরী বধূ, তুমি শুধু আমার, গোলাগুলি, দুই নয়নের আলো, ইত্যাদি।
বুলবুল আহমেদ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি কয়েকটি ছবি প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন। তাঁর প্রযোজীত ও পরিচালিত ছবি- মহানায়ক, ভালো মানুষ, রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত, আকর্ষণ, গরম হাওয়া, কত যে আপন, প্রভৃতি।
বুলবুল আহমেদ চার-চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭), বধু বিদায় (১৯৭৮), শেষ উত্তর (১৯৮০) ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা এবং দীপু নাম্বার টু (১৯৯৬) ছবিতে পার্শ্ব চরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
রূপালী সৈকতে (১৯৭৯), দেবদাস (১৯৮২), ফেরারী বসন্ত (১৯৮৩), রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে পেয়েছেন, বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার।
পারিবারিক জীবনে বুলবুল আহমেদ ১৯৬৩ সালে, অভিনেত্রী ফৌজিয়া আহমেদ ডেইজিকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির তিন সন্তান। মেয়ে ঐন্দ্রিলা ও তিলোত্তমা এবং ছেলে শুভ। ছেলে-মেয়েরাও অভিনয়ের সাথে যুক্তা।
নায়ক বুলবুল আহমেদের স্মৃতিকে ধরে রাখতে এবং প্রবীণ শিল্পীদেরকে সম্মানিত করার প্রয়াসে, পরিবারের পক্ষ থেকে গঠিত হয়েছে ‘বুলবুল আহমেদ ফাউন্ডেশন’।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অন্যতম সুদর্শন, জননন্দিত নায়ক বুলবুল আহমেদ ছিলেন, অসামান্য অভিনয় প্রতিভার অধিকারী। সুশিক্ষিত-পরিমার্জিত রুচিশীল ও সৃজনশীল এক অভিনেতা।
ভিন্নমাত্রার অভিনয় দক্ষতায় অন্যরকম এক নায়কোচিত ইমেজ গড়ে তুলেছেন রূপালী পর্দায়। মেধাবী এই অভিনেতা রুচিশীল সিনেমাদর্শকদের পছন্দের তালিকায় ছিলেন, সবার উপরে। ক্ল্যাসিক বা রোমান্টিক সব ধরণের চলচ্চিত্রে তিনি ছিলেন স্বাছন্দ। অনবদ্য সাবলীল অভিনয় দক্ষতায়, পৌঁছেছেন সব শ্রেণির সিনেমাদর্শকদের মনের, মনিকোঠায়। সিনেমাদর্শকদের দেবদাস-মহানায়ক -ভালোমানুষ, বুলবুল আহমেদ। আর চলচ্চিত্রের মানুষদের কাছে, নিপাট ভদ্রলোক বুলবুল আহমেদ, চিরঅম্লান-চিরঞ্জীব।