আজাদ আবুল কাশেম গুণি অভিনেতা, নাট্যকার, অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ-এর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০১৯ সালের ২ জুন, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। আমাদের সংস্কৃতিঅঙ্গনের মহিরূহব্যক্তিত্ব মমতাজউদদীন আহমদ-এর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ ১৯৩৫ সালের ১৮ জানুয়ারি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত মালদহ জেলার হাবিবপুর থানার আইহো গ্রামে, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কলিমুদ্দিন আহমদ ও মাতার নাম সখিনা বেগম। তিনি মালদহ ‘আইহো জুনিয়র স্কুলে’ চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। দেশ বিভাগের পর তাঁর পরিবার তদানিন্তন পূর্ববঙ্গে চলে আসেন। ১৯৫১ সালে ‘ভোলাহাট রামেশ্বর পাইলট মডেল ইনস্টিটিউশন’ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন। পরবর্তীতে ‘রাজশাহী কলেজ’ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বি.এ (অনার্স) ও এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন।
ছাত্রাবস্থায় তিনি তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। রাজশাহীর ভাষা আন্দোলনকর্মী গোলাম আরিফ টিপুর সাথে তিনি রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনেও ভূমিকা রাখেন। রাজশাহী কলেজে বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণেও তাঁর ভূমিকা ছিল।
১৯৬৪ সালে তিনি ‘চট্টগ্রাম কলেজে’র বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতা শুরু করেন। ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে’র বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে’র নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের খন্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। ১৯৭৬-৭৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
মমতাজউদদীন আহমদ ৩২ বছরেরও বেশি সময়ধরে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কলেজে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ইউরোপীয় নাট্যকলায় শিক্ষাদান করেছেন। তিনি ভারতের দিল্লী, জয়পুর এবং কলকাতায় নাট্যদলের নেতা হিসাবে ভ্রমণ ও নাটক মঞ্চায়ন করেছেন। তাঁর লেখা নাটক ‘কি চাহ শঙ্খ চিল’ এবং ‘রাজা অনুস্বরে’র পালা রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এছাড়াও তাঁর বেশ কিছু নাটক, বাংলাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।
বহুগুণে গুণান্বিত, অসাধরণ প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব
মমতাজউদদীন আহমদ একাধারে শিক্ষক-লেখক-নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা-কাহিনীকার-চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা। কাজ করেছেন মঞ্চে, বেতারে, টেলিভিশনে ও চলচ্চিত্রে। তিনি চলচ্চিত্রের বিভিন্ন শাখায় কাজ করেছেন, যারমধ্যে- লাল সবুজের পালা ( কাহিনীকার-চিত্রনাট্যকার ও সংলাপকার), এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী (অভিনয়), রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, নাতবৌ, ছোট মা, প্রতিক্ষা, কাঠগড়া, বিরাজ বউ, জোহরা ( চিত্রনাট্যকার), চিত্রা নদীর পাড়ে (অভিনয়), শঙ্খনীল কারাগার (অভিনয়), হাছন রাজা ( কাহিনী-চিত্রনাট্য-সংলাপ ও অভিনয়) অন্যতম।
তাঁর রচিত নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে- রাক্ষসী, নাট্যত্রয়ী, বকুলপুরের স্বাধীনতা, হৃদয়ঘটিত ব্যাপার স্যাপার, স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, জমিদার দর্পণ, সাত ঘাটের কানাকড়ি, কি চাহ শঙ্খ চিল, একটি যুদ্ধ অন্য একটি মেয়ে, আমার যত ভালবাসা, হাসিখুশি, তুমি আর আমি শুধু, অন্যরকম ভালবাসা, নিরবে নিঃশব্দে, প্রভৃতি ।
তিনি টেলিভিশনের বহু নাটক লিখেছেন এবং নাটকে অভিনয় করেছেন। সহজ-সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা ও সুধীজন কর্তৃক বহূল প্রশংসা অর্জন করেন মমতাজউদ্দীন আহমদ।
শিক্ষক-লেখক ও অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি পেলেও থিয়েটারের মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনকে তিনি নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায় । আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান চির চিরস্মরণীয়।
তিনি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত।
মমতাজউদদীন আহমদ ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী’তে গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক ছিলেন। তাঁর গবেষণা-প্রবন্ধ ও প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ- বাংলাদেশের নাটকের ইতিবৃত্ত, বাংলাদেশের থিয়েটারের ইতিবৃত্ত, প্রসঙ্গ বাংলাদেশ, প্রসঙ্গ বঙ্গবন্ধু, স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা, ফলাফল নিম্ন চাপ, হরিণ চিতা চিল, কি চাহ শঙ্খচিল, বিবাহ, বাংলাদেশের নাটক ও থিয়েটার।
শিল্প-সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য তিনি জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বহূ পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-১৯৭৬, একুশে পদক-১৯৯৭, নাট্যকলায় অবদানের জন্য ২০০৮-এ ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি’ কর্তৃক বিশেষ সম্মাননা। ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’, আলাউল সাহিত্য পুরস্কার প্রভৃতি।