গীতিকবি-সাহিত্যিক-গবেষক ও শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান-এর ১৩ তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। প্রয়াত এই গুণি ব্যাক্তিত্বের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ১৯৩৬ সালের ১৫ আগস্ট, যশোর জেলাশহরের খড়কী পাড়ায়, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ শাহাদত আলী এবং মায়ের নাম রাহেলা খাতুন। আট ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। তাঁর এক ভাই প্রখ্যাত গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান।
১৯৫৩ সালে যশোর জেলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৫৫ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন।
১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রথমে ফেলো হিসেবে যোগদান করেন ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। ১৯৬২ সালে প্রভাষক পদে নিয়োগ লাভ করেন।
১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭০ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ-এ ব্রিটিশ কাউন্সিল বার্সারী বৃত্তি নিয়ে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করেন তিনি।
১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৮ থেকে ১৮৮১ পর্যন্ত । তাঁর তত্ত্বাবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ জন ছাত্র পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি পরীক্ষক ছিলেন। তাঁর শিক্ষকতা জীবনে তিনি ভ্রাম্যমান অধ্যাপক হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড, বোষ্টন, আইওয়া, শিকাগো ও বার্কেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং প্রফেশনাল এসোসিয়েট হিসাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলা একাডেমীর কার্যিনর্বাহী পরিষদের সদস্যও ছিলেন তিনি।
ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান রচিত প্রথম কবিতা ‘এই আজাদী’ ১৯৫২ সালে ‘ইশারা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দূর্লভ দিন’ প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে । গ্রন্থটি সেই সময়ে সাহিত্যামোদীদের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। তিনি এক সময় কবিতা আবৃত্তিও করতেন। তাঁর আবৃত্তির একটি ক্যাসেটও বের হয়েছিল।
ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান-এর উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থসমূহ- দুর্লভ দিন, শঙ্কিত আলোকে, বিপন্ন বিষাদ, প্রতনু প্রত্যাশা,
ভালবাসার হাতে, ভূমিহীন কৃষিজীবী ইচ্ছে তাঁর, তৃতীয় তরঙ্গে, কোলাহলের পরে, ধীর প্রবাহে, ভাষাময় প্রজাপতি, যশোর কবিতা, ইচ্ছেমতী, অযুত কলি।
এছাড়াও তিনি বিদেশী কবিদের অনেক কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। তাঁর নিজের লেখা কবিতাও- ইংরেজী, ফরাসী, জার্মানি, হিন্দী, উর্দ্দু, রুশ’সহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।
কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি অনেক গবেষণাধর্মী পুস্তকও রচনা করেছেন। সেইসব গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে-
আধুনিক কাহিনী কাব্যে মুসলিম জীবন ও চিত্র, আধুনিক বাংলা সাহিত্য, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক, বাংলা কবিতার ছন্দ, বাংলা সাহিত্যে উচ্চতর গবেষণা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের ইতিহাস, রবীন্দ্র চেতনা, আধুনিক বাংলা কবিতা প্রাসঙ্গিকতা ও পরিপ্রেক্ষিত, ভাষা আন্দোলনঃ শিক্ষায় ভাষা পরিকল্পনা, প্রভৃতি।
সাহিত্যাঙ্গনে নানামূখী প্রতিভার অধিকারী ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সম্পাদনাও করেছেন প্রচুর গবেষণামূলক গ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকা। তিনি নাটকও লিখেছেন। লিখেছেন শিশুসাহিত্যও।
১৯৫৬ সালে থেকে তিনি গান লিখতে শুরু করেছিলেন। তখন ঢাকা রেডিওর জন্য নিয়মিত গান লিখতেন তিনি।
চলচ্চিত্রের জন্য প্রথম গান লেখেন ‘ডাক বাবু’ ছবিতে। মুস্তাফিজ পরিচালিত ছবিটি মুক্তিপায় ১৯৬৬ সালে।
ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান আরো যেসব চলচ্চিত্রে গান লিখেছেন তারমধ্যে- চাওয়া পাওয়া, এতটুকু আশা, ছন্দ হারিয়ে গেল, দ্বীপ নিভে নাই, নীল আকাশের নীচে, অধিকার, নতুন নামে ডাকো, পীচঢালা পথ, অনির্বাণ, বাদশা, অশ্রু দিয়ে লেখা, পরশ মনি, ধীরে বহে মেঘনা, বধূ বিদায়, সোহাগ, দাতা হাতেমতাই, কালো গগোলাপ, ভাঙ্গাগড়া, উসিলা, রাজা সাহেব, অন্যতম।
ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান রচিত, জনপ্রিয় ও কালজয়ী গানগুলোর মধ্যে আছে- তুমি কী দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়…, হলুদ বাটো মেন্দি বাটো বাটো ফুলের মৌ.., দুঃখ সুখের দোলায় দোলে ভব নদীর পানি.., হেসে খেলে জীবনটা যদি চলে যায়.., প্রেমের নাম বেদনা, সে কথা বুঝিনি আগে.., ঐ দূর দূর দূরান্তে.., অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান.., আজ মানুষের দ্বারে, মানবতা কেঁদে মরে.., ঘুর্ণিচাকায় ঘুরছে জীবন এই শহরে ভাই.., আমি রিকশাওয়ালা.., সাগর ভেঙে বন্যার বেগে আয়.., গানের কোকিল আমি ফাগুনের বাসনা ফোটাই.., ও দুটি নয়নে স্বপনে চয়নে নিজেরে যে ভুলে যাই.., দাও গায়ে হলুদ পায়ে আলতা হাতে মেহেদি.., ফুলের কানে ভ্রমর এসে চুপি চুপি বলে যায়.., আমারও দেশেরও মাটিরও গন্ধে, ভরে আছে সারা মন.., একটুস খানি দেখ একখান কথা রাখো.., গান হয়ে এলে.., চলে যায় যদি কেউ বাধঁন ছিড়েঁ কাঁদিছ কেন মন.., তোমাদের সুখের এই নীড়ে…, সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি, ও আমার বাংলাদেশ…, স্বাধীনতা এক গোলাপ ফোটানো দিন.., প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্যের আগে.., ভাষার জন্য যারা দিয়ে গেছে প্রাণ, ভুলিনি তোমাদের আমরা.., বাংলাদেশের স্বাধীনতা লক্ষ প্রাণের দাম.., ভালবেসে তবু যেন সবটুকু ভাল লাগে না.., ইত্যাদি।
ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান তাঁর কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশে ও বিদেশে পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। যারমধ্যে উল্লেখযোগ্য- ১৯৬৯ সালে লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল হুজ হু ইন পোয়েট্রি তাঁকে ‘সার্টিফিকেট অব মেরিট ফর ডিস্টিংগুইশড কন্ট্রিবিউশন টু পোয়েট্রি’ প্রদান করে। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসাবে ‘জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরষ্কার’। সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য ১৯৭২ সালে ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’ ও ১৯৮৭ সালে ‘একুশে পদক’ । ১৯৮০ সালে মস্কো টেলিভিশনে ‘রাদুগা পুরষ্কার’ । ১৯৮২ সালে এশিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়নের রেডিও প্রোগ্রাম কম্পিটিশনে প্রথম পুরস্কার, সাহিত্য সঙ্গীত নাট্য মহাসম্মেলনে মানিকগঞ্জে গুণীজন সংবর্ধনা।
১৯৮৩ সালে আন্তর্জাতিক রোটারী ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ‘দি রোটারী ফাউন্ডেশন অব রোটারী ইন্টারন্যাশনাল সাইটেশেন ফর মেরিটরিয়াস সার্ভিস’-এর সম্মান।
১৯৮৪ সাল- যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (কবিতা), লেখিকা সংঘ স্বর্ণপদক (কবিতা), কালুশাহ সাহিত্য পুরস্কার (গবেষণা), হাসান হাফিজুর রহমান স্বর্ণপদক (প্রবন্ধ), চাঁদের হাট পদক (সাহিত্য)। ১৯৮৮ সালে ‘মাইকেল সাহিত্য পুরস্কার’ (গবেষণা)। ১৯৮৯ সালে ‘শিল্পী কামরুল হাসান পদক’ (সাহিত্য)। ১৯৯১ সালে ‘সাংবাদিক মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ স্বর্ণপদক’ (সাহিত্য)। ১৯৯২ সালে ‘কবিতায় জসিমউদ্দীন পুরস্কার’। ২০০৩ সালে যশোর সুরবিতান সংগীত একাডেমীর পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁকে গুণিজন সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।
ব্যাক্তিজীবনে ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ১৯৬০ সালে, রাশিদা জামান-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্ত্রী, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাদের এক মেয়ে ( চিকিৎসক) ও এক ছেলে (ইঞ্জিনিয়ার) রয়েছে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নন্দিত ব্যাক্তিত্ব, গবেষক, গীতিকবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। সাহিত্যের সকল শাখায় যার অবাধ বিচরণ। আধুনিক বাংলা কাব্যের উজ্জ্বলতম প্রতিভা। মেধাবী-জ্ঞানী ভাষাবিজ্ঞানী তিনি।
এই মহান সাহিত্যিক ও গীতিকবি
চলচ্চিত্রে যত গান লিখেছেন তারমধ্যে বেশিরভাগই শ্রোতা-দর্শক কর্তৃক সমাদৃত ও নন্দিত হয়েছে। হয়েছে জনপ্রিয়, রয়েছে কালজয়ীর তালিকায়। তাঁর গানের সুমধুর বাণী আজও মানুষের হৃদয়কে বিমোহিত করে, উদ্বেলিত করে। তাঁর লেখা দেশাত্ববোধক গানগুলো, বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠে যেন। দেশপ্রেমে ঠাসা কাব্যিক গানগুলো শুনলেই বুঝা যায় তিনি কত উঁচুমাপের গীতিকবি।
ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবী আদায়ে, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অনন্য অবদান অবশ্যই স্মরণযোগ্য।
বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্রপুত্র ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, এ দেশের মানুষের হ্নদয়ে অনন্তকাল বেচেঁ থাকবেন, অমর হয়ে থাকবেন।