English

19 C
Dhaka
সোমবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪
- Advertisement -

খোন্দকার নূরুল আলম: দেশবরেণ্য সংগীতজ্ঞের অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

- Advertisements -

এ কে আজাদ: খোন্দকার নূরুল আলম। সুরকার-সংগীত পরিচালক ও কন্ঠশিল্পী। বাংলাদেশের সঙ্গীতের মহিরুহ ব্যক্তিত্ব। বাংলা গানে মৌলিক সুর সৃষ্টির মহান কারিগর বলা যায় তাঁকে।

বেতার-টেলিভিশনের বহু দেশাত্মবোধক ও আধূনিক জনপ্রিয় কালজয়ী বাংলা গানের সুরস্রষ্টা তিনি।
একজন প্রথিতযশা সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে, আমাদের চলচ্চিত্রের সংগীতকেও করেছেন সমৃদ্ধ, অধিষ্ঠিত করেছেন অনন্য উচ্চতায়। ‘চোখ যে মনের কথা বলে….’ তাঁর গাওয়া ও সুর করা এই গানটি, বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা গানগুলোর একটি হিসেবে অবিহিত করা হয়।

বহু কালজয়ী জনপ্রিয় গানের সুরকার খোন্দকার নূরুল আলম কন্ঠও দিয়েছেন জনপ্রিয় অনেক গানে।
আজ এই দেশবরেণ্য সংগীতজ্ঞের অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী।

তিনি ২০১৬ সালের ২২ জানুয়ারী, ৮০ বছর বয়সে, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুদিবস-এ প্রয়াত এই গুণী সংগীতজ্ঞের প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

খোন্দকার নূরুল আলম ১৯৩৬ সালের ১৭ আগস্ট, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসামের ধুবড়ীতে, জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম খান বাহাদুর খোন্দকার নেসার উদ্দিন (সাবেক ডিএম) এবং মাতার নাম মোসাম্মৎ ফাতেমা খাতুন। ছেলেবেলা কাটে আসামের গোয়ালপাড়ায়। দেশভাগের পর পরিবারসহ বাংলাদেশে চলে আসেন। ১৯৫৪ সালে, নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও ১৯৫৬ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন তিনি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। এখানে পড়াকালীন সময়েই তিনি সুর ও সঙ্গীতে আগ্রহী হয়ে উঠেন।

খোন্দকার নূরুল আলম সর্বপ্রথম উচ্চাংগ সংগীতে শিক্ষা লাভ করেন, ওস্তাদ ইউসুফ খান কোরেশী এবং ওস্তাদ ইয়াসীন খান-এর কাছ থেকে।
১৯৫৯ সালে তৎতকালীন রেডিও পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ বেতার) ঢাকা কেন্দ্রের সংগীত প্রযোজক হিসেবে যোগদান করেন। কর্মজীবনের শুরুতে, বেতার আয়োজিত “নব মঞ্জুরী” নামক অনুষ্ঠান প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন খোন্দকার নূরুল আলম। এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন সাবিনা ইয়াসমিন, শাহনাজ রহমতুল্লাহর মত (তখনকার সময়ে) শিশুশিল্পীরা। বাংলাদেশ বেতার থেকে ১৯৯৬ সালে, উপমূখ্য সংগীত প্রযোজক হিসেবে অবসর গ্রহন করেন। পাশাপাশি তিনি ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং একাডেমীর সংগীত বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রভাষকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৬০ সালে তিনি গ্রামোফোন কোম্পানি হিজ মাস্টার্স ভয়েস-এ যোগ দেন। সেখান থেকে তাঁর সঙ্গীত পরিচালনায় তৎকালীন সময়ের অনেক নামকরা কণ্ঠশিল্পীদের গানের রেকর্ড বের হয়।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের সুচনালগ্ন থেকেই সুরকার এবং গীতিকার হিসেবে জড়িত ছিলেন তিনি । তাঁর পরিচালিত “সুরবিতান” অনুষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল।

খোন্দকার নূরুল আলম প্রথম কণ্ঠশিল্পী হিসেবে সঙ্গীত জগতে আসলেও, জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি লাভ করেন সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে। প্রথমে তিনি একটি উর্দু ছবির সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রাঙ্গনে প্রবেশ করেন। তিনি যেসব চলচ্চিত্রে সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন তারমধ্যে- ইস্ ধরতি পর, উলঝন, যে আগুনে পুড়ি, অন্তরঙ্গ, জলছবি, অংগীকার, ওরা ১১ জন, সংগ্রাম, জীবন তৃষ্ণা, চোখের জলে, কার হাঁসি কে হাঁসে, আঁধারে আলো, চলো ঘর বাঁধি, অনন্ত প্রেম, বিরহ ব্যথা, স্মাগলার, শত্রু, পিঞ্জর, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, কাজল লতা, শুভদা, রাজলক্ষী শ্রীকান্ত, বিরাজ বৌ, জন্মদাতা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, আজকের প্রতিবাদ, শঙ্খনীল কারাগার, শাস্তি, উল্লেখযোগ্য।

চলচ্চিত্রের গান ছাড়াও খোন্দকার নূরুল আলম আধুনিক গান, ফোক গান, দেশের গান, পল্লীগীতি ও বিখ্যাত কিছু কবিতায় সুরারোপ করেছেন। এছাড়া তিনি জাতীয় ক্রীড়া সঙ্গীত, স্কাউট মার্চ সঙ্গীত, আনসার-ভিডিপি দলের সঙ্গীত, রোটারি ক্লাবের বাংলা ও ইংরেজি উভয় গানের সুর করেছেন। গীত রচনা এবং গানের স্বরলিপি ও স্টাফ নোটেশন করার কাজও করেছেন সঙ্গীতের এই মহান ব্যক্তিত্ব।

বাংলা গানের স্বর্ণালীযুগ সৃষ্টির অন্যতম কারিগর খোন্দকার নূরুল আলম। তাঁর সুর করা কালজয়ী জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে- চোখ যে মনের কথা বলে…, আমায় একটা ক্ষুদিরাম দাও বলে কাঁদিস না আর মা…, নদীর মাঝি বলে….., ভুল যদি হয় মধুর এমন হোক না…, এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে…, এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে…, জনম জনম ধরে প্রেম পিয়াসী…, এত সুখ সইবো কেমন করে…., তুমি এমনই জাল পেতেছ সংসারে…, সাথী আমার হলো না তো কেউ…., আমি এক রিকসওয়ালা…, পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝর্ণা বলো…, হৃদয়ে এতো যে কথার কাঁকন…, আকাশটাতো নীল চিঠি নয়…., আমার হাত দেখে তুমি বলো তো…, এদেশ আমার জননী আমার…, আমার মন পাখিটা যায়রে উরে…, অনেক বড় ঘরণীও ঘর পায় না…, ঐ রাত ডাকে ঐ চাঁদ ডাকে তুমি কোথায়…., তোমার এ উপহার আমি চিরদিন…, কাঠ পুড়লে কয়লা হয়…, একটা ফুলে হয় না তোড়া…, মন তো নয় আর আয়না…, আমি মানুষের মত বাঁচতে চেয়েছি…, ফুলের বাসর ভাঙলো যখন…, কারে বলবো আমি মনের কথা…, তোমায় না দেখিলে চক্ষু আন্ধার…, মন আমার ছোট্রবাসা, সে বড়ো ভালোবাসা…, মন রে ও মন, সুখ পাখি তোর হইলো না আপন…, অন্যতম উল্লেখযোগ্য ।

কন্ঠশিল্পী হিসেবে তিনি অনেক গান গেয়েছেন। সেসব গান জনপ্রিয়ও হয়েছে। তিনি চলচ্চিত্রেও কন্ঠ দিয়েছেন। তাঁর গাওয়া ‘চোখ যে মনের কথা বলে….’ গানটি তো ইতিহাস হয়ে আছে, তারপর ‘ আমার হাত দেখে তুমি বলো তো…’ এ গানটিও বেশ জনপ্রিয় ।
এছাড়াও তিনি গেয়েছেন দেশাত্মবোধক গান, ‘দু’নয়ন ভরে যত দেখি তাঁরে…’, আধুনিক গান, ‘আমি চাঁদকে বলেছি আজ…’, ‘প্রথম দেখায় লাগলো ভালো…’, পৃথিবী যে কত সুন্দর…,’। এসব গানও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।

খোন্দকার নূরুল আলম তাঁর কর্মের স্বিকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা, যারমধ্যে আছে- জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার: শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক- চন্দ্রনাথ (১৯৮৪), শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক- শুভদা (১৯৮৬), শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক- পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৯১)।
বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার: শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক- দেবদাস(১৯৮২), শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক- চন্দ্রনাথ(১৯৮৪), শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক- শুভদা(১৯৮৬)।
চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি পুরস্কার: শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক- পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৯১)। শহীদ আলতাফ মাহমুদ স্মৃতি পুরস্কার, রাজা হোসেন খান স্মৃতি পদক-১৯৯৪, সরগম ললিতকলা পদক-২০০৩, ডেইলি স্টার সেলিব্রেটিং লাইফ বিজয়ী: আজীবন সম্মাননা-২০১১।
সর্বোপরি তিনি পেয়েছেন একুশে পদক-২০০৮।

ব্যক্তিজীবনে খোন্দকার নুরুল আলম ১৯৭৬ সালে, কিশোয়ার সুলতানার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই সন্তান। মেয়ে আমানি খোন্দকার ও ছেলে আবীর খোন্দকার।

বাংলা সংগীতের ভাণ্ডার সমৃদ্ধি করতে বাংলা গানকে সর্বমহলে পৌঁছে দিতে যাদের অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্নাক্ষরে লেখা থাকবে, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন- খোন্দকার নূরল আলম।

Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন