কাঞ্চনের সুবর্ণ সময়টি ছিল আশি থেকে মধ্য নব্বই পরবর্তী পর্যন্ত। অসাধারণ অসাধারণ সব ছবি এসেছে এই সময়ে—
১৯৮৫ এর প্রথম দিকে একেবারে ভিন্ন গেটআপে রোমান্টিক ‘প্রেম কাহিনী’তে চোখে চশমা নিয়ে একেবারে ইনোসেন্ট বয় লুকে সবাইকে চমকে দেন তিনি, পরিচালক ছিলেন অভিনেতা দারাশাকো, সহশিল্পী ছিলেন দোয়েল। চমৎকার নির্মাণের সঙ্গে কাঞ্চন-দোয়েলের রসায়ন দারুণভাবে উপভোগ করেছিল দর্শক। ছবির ‘আমি যে প্রেমে পড়েছি আমি যে প্রাণে’ গানটি দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সে বছর আরেকটি জনপ্রিয় ছবি ছিল শিবলী সাদিকের ‘তিন কন্যা’, যে ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন তিন বোন সুচন্দা, ববিতা ও চম্পা।
৮৬ সাল কাঞ্চনের জন্য বেশ উল্লেখ্যযোগ্য, এ বছর তিনি প্রথমবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান, গুণী নির্মাতা আলমগীর কবিরের ‘পরিণীতা’ ছবিতে অসামান্য অভিনয়ের গুণে। বছরের শুরুতেই মতিউর রহমান পানু পরিচালিত ‘ইনসাফ’ (০৭/০২/১৯৮৬) এর মতো হিট ছবি উপহার দেন। এরপর ‘বাল্যশিক্ষা’, ‘বিষ কন্যার প্রেম’, ‘তওবা’, ‘ভাই বন্ধু’, ‘পরিণীতা’, ‘নবাব’-এর মতো সফল সব ছবি আসে এই সময়ে। তবে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠে ‘ভাইবন্ধু’, কাঞ্চন ছাড়াও ছবিটিতে আরও ছিলেন জাফর ইকবাল, সুনেত্রা, দিতি, সোহেল চৌধুরীর মতো তারকারা। দারাশিকোর অসাধারণ নির্মাণ আর শ্রুতিমধুর সব গানে আজও সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের মনে জায়গা করে আছে।
পরের বছর ‘প্রতিরোধ’, ‘স্বর্গ নরক’, ‘মর্যাদা’, ‘সহযাত্রী’, ‘দায়ী কে?’-এর মতো ছবি উপহার দেন ইলিয়াস কাঞ্চন, যার মধ্যে ‘প্রতিরোধ’, ‘সহযাত্রী’, ‘দায়ী কে?’ আলাদাভাবে উল্লেখ্য।
ইলিয়াস কাঞ্চনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বছর ছিল ১৯৮৮ সাল, সঙ্গে ১৯৮৯-কেও আনতে হয়। কারণ ৮৯ সালে বাংলা চলচ্চিত্রে ঘটে যায় এক অবিস্মরণীয় ঘটনা, এই সালের ১ জুন মাসের মুক্তি পাওয়া ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ দেশের চলচ্চিত্রের ব্যবসার হিসেব-নিকেশ পাল্টে দিয়েছিল। তূমুল জনপ্রিয় ছবিটি এখনও দেশের সব্বোর্চ আয়ের রের্কড হয়ে আছে। তোজাম্মেল হক বকুলের পরিচালনায় সহশিল্পী অঞ্জু ঘোষকে নিয়ে ছবিটির এমন সফলতায় কাঞ্চন সাহেব উচ্ছ্বসিত হতেই পারেন। ‘জীবন বাজী’, ‘বিধাতা’, ‘শিকার’, ‘গৌরব’, ‘দুর্নাম’, ‘নিকাহ’, ‘এক দুই তিন’, ‘ছেলে কার’, ‘খুনী’, ‘শর্ত’, ‘সহধর্মিনী’র মতো ছবিগুলোও ছিল একই বছরের তালিকায়।
৮৮ সালের শুরুতেই ‘আদিল’-এর মতো হিট ছবি দিয়ে যাত্রা শুরু করেন কাঞ্চন। যার ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন ‘নীতিবান’, ‘হুশিয়ার’, ‘ভেজা চোখ’, ‘স্বর্পরানী’র মতো হিট সুপারহিট ছবিগুলো দিয়ে। বিশেষ করে শিবলী সাদিকের ‘ভেজা চোখ’-এ দর্শকদের মন ভিজিয়ে দিলেন। বাম্পারহিট করলো ছবিটি, ক্যানসারে আক্রান্ত মরণাপন্ন তরুণের চরিত্রে হৃদয় নিংড়ানো অভিনয়ে মাত করে দিলেন পুরো দেশের সিনেমা দর্শকদের। কাঞ্চনের অভিনয়ে ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’ গানটি দেখে কাঁদেনি এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া যাবে না তা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।
নব্বই দশকের শুরুতেই কামরুজ্জামান পরিচালিত ‘প্রেম প্রতিজ্ঞা’র (০২/০৩/১৯৯০) মতো হিট ছবি দিয়ে নতুন দশক শুরু করলেন কাঞ্চন। ওই বছর উপহার দিলেন ‘ঘর ভাঙ্গা ঘর’, ‘কৈফিয়ত’, ‘ঘর আমার ঘর’, ‘শঙ্খমালা’, ‘স্বাধীন’, ‘আদেশ’, ‘কুসুম কলি’, ‘বিশ্বাস অবিশ্বাস’-এর মতো সফল চলচ্চিত্র। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সালে অকৃতজ্ঞ, বাদশা ভাই, রঙ্গীন মালকা বানু, শ্বশুড় বাড়ী, সম্মান, অচেনা, আয়না বিবির পালা, বাপ বেটা ৪২০, ১৯৯২ সালে মা মাটি দেশ, দায়িত্ব, মাটির কসম, ঘরের সুখ, চাকর, বন্ধন, রক্তের বদলা, বেপরোয়া, প্রেমের প্রতিদান, দংশন, গাড়িয়াল ভাই, ১৯৯৩ সালে বিক্রম, আত্মবিশ্বাস, রূপের রানী গানের রাজা, খুনী আসামী, ত্যাগ, মহৎ, ১৯৯৪ সালে মহাগ্যাঞ্জাম, সিপাহী, আতংক, হত্যা, সৎ মানুষ, সবার উপরে মা, গোলাপী এখন ঢাকায়, চরম আঘাত, আসামী গ্রেফতার, ১৯৯৫ সালে কমান্ডার, পাষাণ, ভাংচুর, প্রতিশোধের আগুন, আদরের সন্তান, শেষ রক্ষা, দুর্নীতিবাজ, মহাযুদ্ধ, ১৯৯৬ সালে স্বজন, বাঁশিওয়ালা, আত্মত্যাগ, বদসুরত, স্নেহের প্রতিদান, দুর্জয়, কালু গুণ্ডা, ১৯৯৭ সালে গোলাগুলি, শাস্তির বদলে শাস্তি, গুন্ডা পুলিশ, বডিগার্ড, দরদী সন্তান, আম্মা, অচেনা মানুষ, বাঁচার লড়াই, ফাঁসি, আত্মপ্রকাশ, অন্ধ ভালোবাসা, একজন বিদ্রোহী, ১৯৯৮ সালে মৃত্যুর মুখে, অচল পয়সা, আমার দেশ আমার প্রেম, ভাই, আমি এক অমানুষ, রক্তের অধিকার, বদলা নেবো, ১৯৯৯ সালের রাজার ভাই বাদশা, স্পর্ধা, মুন্না মাস্তান, ভন্ড প্রেমিক, ভাই কেন আসামী, জবর দখল, মনের মিলন, শিবা গুন্ডা অন্যতম। পরের দিকের উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে জিদ্দি সন্তান (২০০০), বিদ্রোহী আসামী (২০০০), চেয়ারম্যান (২০০১) ভালোবাসার শত্রু (২০০২), শাস্তি (২০০৫), বিদ্রোহী পদ্মা (২০০৬), নিরন্তর (২০০৬) ও নিঝুম অরণ্যে (২০১০) অন্যতম। ইলিয়াস কাঞ্চনের মুক্তি পাওয়া সর্বশেষ সিনেমা ২০১৮ সালে ইফতেখার চৌধুরী পরিচালিত ‘বিজলি’। সম্প্রতি রোজিনার পরিচালনায় এ নায়িকার বিপরীতে ‘ফিরে দেখা’ ছবিতে অভিনয় করেন।
দীর্ঘ অভিনয় জীবনে ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে বেশ কয়েকজন অভিনেত্রীর চমৎকার জুটি গড়ে উঠেছিল, যার মধ্যে দিতি, চম্পা, অঞ্জু ঘোষরা এগিয়ে থাকবেন। মূলত এই তিনজনের সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি জুটি হয়ে অভিনয় করেছেন— এর মধ্যে দিতির সঙ্গে করেছেন সর্বোচ্চ ৪২টি চলচ্চিত্র, এ জুটির প্রথম ছবি বশিরুল হক পরিচালিত ‘অপারাধী’ (০৩/০৩/১৯৮৯) ও সর্বশেষ নূর মোহাম্মদ মনি পরিচালিত ‘পদ্মা আমার জীবন’ (১৬/০৫/২০০৮)। এরপর চম্পার সঙ্গে ৩১টি চলচ্চিত্রে— প্রথম ছিল শিবলী সাদিক পরিচালিত ‘তিনকন্যা’ (২০/১১/১৯৮৫) ও জুটি হয়ে শেষ ছবিটি ছিল শওকত জামিল পরিচালিত ‘যেখানে তুমি সেখানে আমি’ (১১/০৬/২০১০)৷ উল্লেখ্য ‘তিনকন্যা’ দিয়েই চম্পার চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়।
অঞ্জুর সঙ্গে ৩০টি ছবিতে একসঙ্গে দেখা গেছে কাঞ্চনকে, এমএম সরকার পরিচালিত ‘মর্যাদা’ (১৯/০৩/১৯৮৭) দিয়ে শুরু আর শেষ ছবিটি ছিল মো. আসলাম পরিচালিত ‘মহান বন্ধু’। চম্পা-দিতি-অঞ্জু ছাড়াও অভিনয়ের প্রথমভাগে ববিতার সঙ্গে ভালো একটি জুটি গড়ে উঠেছিল। প্রথম ছবিসহ পরপর তিনটি ছবি ‘বসুন্ধরা’, ‘ডুমুরের ফুল’, ‘সুন্দরী’তে ববিতার সঙ্গেই জুটি হন। এ ছাড়া চতুর্থ ছবি ‘শেষ উত্তর’-এ শাবানার সঙ্গে অভিনয় করলেও ওই একটি ছবিতেই তাদের জুটি আটকে ছিল। এ ছাড়া কাঞ্চনের নায়িকা তালিকায় ছিলেন সুচরিতা, কাজরী, রোজিনা, জুলিয়া, নূতন, সুনেত্রা, নিপা মোনালিসা, রানী, অঞ্জনা থেকে পপি, মোসুমী, মুনমুন, শাবনাজসহ অনেকেই।
ইলিয়াস কাঞ্চন অভিনয়ের পাশাপাশি করেছেন চলচ্চিত্র প্রযোজনাও। ১৯৯২ সালে ‘মাটির কসম’ দিয়ে যাত্রা করে তার জয় চলচ্চিত্র, পরিচালক ছিলেন কামারুজ্জামান। পরবর্তীতে ‘বেনাম বাদশা’, ‘খুনী আসামী’, ‘শেষ রক্ষা’সহ কয়েকটি ছবি প্রযোজনা করেন। ২০০৮ সালে প্রযোজনার পাশাপাশি ‘বাবা আমার বাবা’ ও ‘মায়ের স্বপ্ন’ দুটি চলচ্চিত্র পরিচালনাও করেন।
ব্যক্তিজীবনে ১৯৭৯ সালে জাহানারা কাঞ্চনের সঙ্গে ইলিয়াস কাঞ্চনের কাবিন হলেও ১৯৮৩ সালে তাকে ঘরে তুলেন। জাহানারা ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর তারই শুটিং দেখতে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। প্রচণ্ড ভালোবাসতেন সহধর্মিনীকে, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ও জনসচেনতা থেকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন, প্রায় ২৮ বছর ধরে তিনি এখনো নিরলসভাবে নিরাপদ সড়ক নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।
সব মিলিয়ে সঠিক চলচ্চিত্র নির্বাচন, সুঅভিনয় ও কাজের প্রতি নিষ্ঠাই তাকে ঠাঁই দিয়েছে আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তির স্থানে।
ইলিয়াস কাঞ্চন অভিনীত জনপ্রিয় কিছু গান— রংধনু ছড়িয়ে চেতনার আকাশে হাসে (বসুন্ধরা), কেউ কোনদিন আমারে তো কথা দিলো না (সুন্দরী), কী করে বলিব আমি (সুন্দরী), তোমার কাছে আমি যাবো না (ছেলে কার), গরম গরম মনটা আমার (বিষ কন্যার প্রেম), তোমাকে পেয়ে জীবন পেলাম (সর্পরানী), তোমাকে চাই আমি আরো কাছে (নসিব), আজ রাত সারা রাত জেগে থাকবো (নীতিবান), পৃথিবীর যত সুখ (সহযাত্রী), মন আমার ছোট্ট বাসা সে বড় ভালোবাসা (জন্মদাতা), ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা (ভাই বন্ধু), তুমি এলে সমুখে (ভাই বন্ধু), বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে (বেদের মেয়ে জোছনা), আমি বন্দি কারাগারে (বেদের মেয়ে জোছনা), বেলি ফুলের মালা পরে (বেপরোয়া), ঐ ভীরু মন আমার মনে (ভালো মানুষ), আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে (আঁখি মিলন), কথা বলবো না বলেছি (আঁখি মিলন), বলো না কোথায় ছিলে (ত্যাগ), চল চল চল আমার গাড়ী (আসামী গ্রেফতার), মন আমার মুক্ত বলাকা (মর্যাদা), প্রেম কখনও মধুর (মহৎ), তুমি ছিলে মেঘে ঢাকা চাঁদ(দায়ী কে?), আকাশকে প্রশ্ন করো (শর্ত), জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প (ভেজা চোখ), তুই তো কাল চলে যাবি (ভেজা চোখ), প্রিয়া আমার প্রিয়া (ভেজা চোখ), ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয় (চরম আঘাত), পিরিতি করিয়া (কুসুম কলি), ভালোবাসার সাধ (বাঁচার লড়াই), এ জীবন তোমাকে দিলাম (আত্মত্যাগ), চিরদিন এই দুনিয়া(আত্মবিশ্বাস), আমি সবকিছু ভুলে যাই (অবলম্বন), যে জীবনে তুমি ছিলে না (সুখের ঘরে দুঃখের আগুন), জীবনে মরণে তুমি মোর সখা (চাঁদ কুমারী চাষার ছেলে), বড় লোকের বেটি গো (চাকর), তোমার সাথে কিছু কথা ছিল (অজানা শত্রু), চতুর গোয়ালিনী রসের বিনোদিনী (রাধাকৃঞ্চ), মন বাধা পড়েছে ঐ যে মনে (দুর্নাম), মনের ঘড়ির কাঁটা (দংশন), ছেলে দেখলে মেয়ের যখন (ঘরের সুখ) ও ওগো সাথী আমার তুমি কিছু বলো না (মর্যাদা)।
আরো পড়ুন: ‘মাত্র ২১ বছরের সেই তরুণকে সুভাষ দত্তের মতো মহারথীর চিনতে একটুকুও ভুল হয়নি’ (পর্ব-১)