আজাদ আবুল কাশেম: অভিনয়ে অসামান্য প্রতিভার অধিকারী-জননন্দিত সৃজনশীল নান্দনিক অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি। বহুল জনপ্রিয় এই অভিনেতার দশম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, বসন্তের প্রথম প্রহরে, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। প্রয়াত এই গুণি অভিনয়শিল্পী’র স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত প্রার্থনা করি।
অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি ( হুমায়ুন কামরুল ইসলাম ফরীদি) ১৯৫২ সালের ২৯ মে, ঢাকার নারিন্দায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম এটিএম নূরুল ইসলাম, মা বেগম ফরিদা ইসলাম। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।
নিজ গ্রাম কালীগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষা
লাভ করেন । পরে পিতার চাকুরীর সুবাদে ১৯৬৫-তে মাদারীপুরের ‘ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে’ ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯৬৮ সালে, এসএসসি এবং চাঁদপুর কলেজ থেকে ১৯৭০-এ এইচএসসি পাস করেন।
হুমায়ুন ফরীদি মূলত মাদারীপুরে থাকার সময়েই নাট্যঙ্গনের সাথে জড়িত হন। তাঁর নাট্যগুরু বাশার মাহমুদের ‘শিল্পী নাট্যগোষ্ঠী’র সাথে যুক্ত হয়ে, কল্যাণ মিত্রের ‘ত্রিরত্ন’ নাটকে অভিনয়ের মধ্যদিয়ে তিনি মঞ্চনাটকে যাত্রা শুরু করেন।
হুমায়ুন ফরীদি ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়ন বিভাগে অনার্স কোর্সে ভর্তি হন, কিন্তু সেসময়েই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে তিনি তাঁর পিতার কর্মস্থল চাঁদপুরে চলে যান এবং সেখান থেকেই মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন।
স্বাধীনতার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক (সম্মান) কোর্সে ভর্তি হন এবং স্নাতক ফাইনাল পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেন। ১৯৭৬-এ নাট্যজন সেলিম আল দীন-এর উদ্যোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় নাট্যোৎসব। এই উৎসবে হুমায়ুন ফরীদির নিজের রচনায় এবং নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় ‘আত্মস্থ ও হিরন্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক। সেই উৎসবে সেরা নাটকের স্থান লাভ করে তাঁর এই নাটকটি।
ঢাকা থিয়েটারে হুমায়ুন ফরীদি অভিনীত উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক- মুনতাসীর ফ্যান্টাসি, ফণীমনসা, শকুন্তলা, কীত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল প্রভৃতি। এসমস্ত নাটকে অনন্য অভিনয় প্রতিভার স্ফুরণ ঘটিয়ে হয়ে যান সেসময়ের মঞ্চ নাটকের একচ্ছত্র অধিপতি, অদ্বিতীয় এক নাট্যাভিনেতা। নাট্যপাড়ায় হুমায়ূন ফরীদি তখন শক্তিমান অভিনেতাদের অন্যতম একজন-এ পরিনত হন।
টেলিভিশন নাটকে হুমায়ুন ফরীদির অভিষেক ঘটে আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘নিখোঁজ সংবাদ’ নাটকের মধ্যমে। টেলিভিশনে তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে- নীল নক্সার সন্ধানে, দূরবীন দিয়ে দেখুন, ভাঙ্গনের শব্দ শুনি, বকুলপুর কত দূর, দু’ভুবনের দুই বাসিন্দা, একটি লাল শাড়ি, মহূয়ার মন, সাত আসমানের সিঁড়ি, একদিন হঠাৎ, চান মিয়ার নেগিটিভ-পজেটিভ, সংসপ্তক, পাথর সময়, শীতের পাখি, সমুদ্রের গাঙচিল, তিনি একজন, চন্দ্রগ্রস্ত, কাছের মানুষ, মানিক চোর, মোহনা, ভবের হাট, শৃংখল, প্রিয়জন নিবাস অন্যতম।
টিভি নাটকে হুমায়ুন ফরীদির অভিনয় ছিল অনন্য-অসাধরণ। যখন যে চরিত্রে ছিলেন মনে হতো এ চরিত্র শুধু যেনো তাঁর জন্যই সৃষ্টি। তিনি চরিত্রের মধ্যে প্রবেশ করতেন, না চরিত্র তাঁর মধ্যে তা বুঝা মুশকিলই ছিল। সব চরিত্রকেই তিনি ভিন্নমাত্রায়, ভিন্ন আঙ্গিকে রূপায়ন করেছেন তাঁর বহুমাত্রিক অভিনয় প্রতিভার মাধ্যমে। টিভি পর্দায় হুমায়ুন ফরিদীর নাটক মানেই দর্শক চাহিদার, অন্যরকম ভালো লাগার যোজনা। অভিনয়ের মায়াজালে টিভি’র সামনে দর্শক-শ্রোতাদের বসিয়ে রাখার এক যাদুকরি ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা ছিল তাঁর । হুমায়ূন ফরিদীর অভিনয় গুণে নাটকের চরিত্রগুলো এতো প্রানবন্ত, এতো জীবন্ত হয়ে উঠত, যেন আমাদের চারপাশের মানুষগুলোই দেখতে পাচ্ছি টিভি’র পর্দায়। “সংশপ্তক” নাটকে ‘কান কাটা রমজান’ চরিত্রের অভিনয় যারা দেখেছেন তাঁরা হুমায়ূন ফরিদীকে স্থান দিয়েছেন পরাণের একেবারে গহীনে।
টিভি নাটকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থানকারী হুমায়ূন ফরীদি অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্র তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’ (স্বল্পদৈর্ঘ)। এরপরে- দহন, সূচনা (স্বল্পদৈর্ঘ), একাত্তরের যীশু।
শহীদুল ইসলাম খোকন-এর ‘সন্ত্রাস’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর বানিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু।
হুমায়ূন ফরীদি অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অাছে- দিনমজুর, বীরপুরুষ, সাহস, বিশ্ব প্রেমিক, আজকের হিটলার, দুর্জয়, শাসন, সৎমানুষ, রাক্ষস, ঘরের শত্রু, আঞ্জুমান, পালাবি কোথায়, আনন্দ অশ্রু, দূরত্ব, মায়ের অধিকার, আসামী বধু, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, ভালোবাসি তোমাকে, ভণ্ড, ঘাতক, কমান্ডার, টাকার অহংকার, মমতাজ, অধিকার চাই, মিথ্যার মৃত্যু, ত্যাগ, মায়ের মর্যাদা, বিদ্রোহী চারিদিকে, শুধু তুমি, কন্যাদান, বিচার হবে, ডন, পিশাচ, মনে পড়ে তোমাকে, বীরসৈনিক, রাঙা বউ, শান্ত কেন মাস্তান, কুলি, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, গুন্ডা নাম্বার ওয়ান, প্রবেশ নিষেধ, মাতৃত্ব, টাকা, ব্যাচেলর, জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়া, রুপকথার গল্প, চেহারা, আহা!, প্রিয়তমেষু, কি যাদু করিলা, রিটার্ণ টিকিট, যেমন জামাই তেমন বউ, মেহেরজান, এক কাপ চা প্রভৃতি।
তুমূল জনপ্রিয় অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি, মঞ্চ-টেলিভিশন-চলচ্চিত্র, যখন যেখানে, যে কাজ করেছেন, তাঁর সব কাজই শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে। নায়ক-খলনায়ক-হরর-কমেডি যে চরিত্রই করেছেন, সবসময় সব চরিত্রে’ই উৎড়ে গেছেন সমান পারদর্শিতার সাথে। জাত অভিনেতা বলতে যা বুঝায়, তিনি ছিলেন তাই। রক্তের শিড়ায়-উপশিড়ায় মিশে ছিলো তাঁর শুধুই অভিনয়। তিনি অভিনয়ে এতোটাই অনবদ্য ছিলেন যে, একসময় নায়কের চেয়ে ভিলেন হুমায়ূন ফরীদি বেশি প্রিয় হয়ে ওঠেন বাংলা সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের কাছে । বাংলা সিনেমায় ভিলেনের সংজ্ঞাটাও পরিবর্তন হয়েগিয়েছিল তাঁর অভিনয় উৎকর্ষতার প্রভাবে। এক কথায় হুমায়ূন ফরীদি ছিলেন বাংলাদেশের অভিনয় জগতের বাদশা।
তিনি প্রায় ২৫০ টির মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন, যার প্রায় সবগুলোই বানিজ্যিকভাবে সফল হয়েছে।
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরুপ তিনি ‘মাতৃত্ব’ (২০০৪) চলচ্চিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
নাট্যাঙ্গনে অসামান্য অবদানের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ৪০ বছরপূর্তি উপলক্ষে তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে। অভিনয়শিল্পে অনন্য অবদানের জন্য, একুশে পদক-২০১৮ (মরণোত্তর) লাভ করেন হুমায়ুন ফরীদি।
ব্যক্তিগতজীবনে হুমায়ুন ফরীদি দু’বার বিয়ে করেন। বেলি ফুলের মালা দিয়ে ফরিদপুরের মেয়ে মিনুকে বিয়ে করেন প্রথম । তখন এ বিয়ে সারা দেশে ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ ঘরে মিনু-ফরিদী’র ‘দেবযানি’ নামে এক কন্যাসন্তান রয়েছে। পরে তিনি ঘর বাঁধেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে। তাঁর মৃত্যুর চারবছর আগে সুবর্ণা-ফরীদি’র বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
বাংলাদেশের মানুষের অতি প্রিয় অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি।সবচেয়ে শক্তিমান-অবিসংবাদিত এক বর্নিল অভিনেতা। আামাদের অভিনয় জগতের ও শিল্প-সংস্কৃতির বর্নাঢ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি৷
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র তথা শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাসে
অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি’র নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
আমাদের সবার প্রিয়, বড় ভালোমানুষ হুমায়ুন ফরীদি, অনন্তলোকে ভালো থাকুন- এই প্রার্থণা করি।