নাসিম রুমি: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতা অভিনয় ছেড়েছেন প্রায় এক দশক আগে। কথা ছিল মানসম্মত ছবি নির্মাণ করা হলে আবার ফিরবেন। তা আর হচ্ছে না। এখনকার ছবি নিয়ে হতাশ তিনি।
চলচ্চিত্রের নানা অবস্থা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন ববিতা।
জীবন্ত কিংবদন্তি এই অভিনেত্রী আক্ষেপ নিয়ে বলেন, আমাদের প্রিয় চলচ্চিত্র অঙ্গনের অবস্থা এখন মোটেও ভালো বলা যাবে না। এমনটি আমরা কখনো চাইনি। চলচ্চিত্র হচ্ছে দেশের প্রধান গণমাধ্যম।
একসময় আমাদের চলচ্চিত্রের ছিল বিশ্বজোড়া খ্যাতি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে আমাদের চলচ্চিত্র অংশ নিত। সম্মান বয়ে আনত। আমাদের শিল্পীরা তাসখন্দসহ পৃথিবীর বড়মাপের সব চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করতেন।এ দেশের ছবি আর শিল্পীদের বাইরের দেশে সম্মানের সঙ্গে দেখা হতো। এখন কি সেই অবস্থা আছে?
চলচ্চিত্রের নামে কী হচ্ছে? নির্মাণ, অভিনয়, গান, গল্প, পোশাক-পরিচ্ছদ এক কথায় সব ক্ষেত্রেই চলছে অপসংস্কৃতি আর অবক্ষয়। এ অবস্থায় চলচ্চিত্র অঙ্গনের দিকে তাকালে বুকটা ব্যথায় কুঁকরে ওঠে। তবে মাঝে মধ্যে দু-একটি ভালো ছবি যে একেবারেই নির্মাণ হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। তবে এই স্বল্প পরিমাণের ছবি দিয়ে কী এত বড় একটি ইন্ডাস্ট্রি টিকিয়ে রাখা সম্ভব?
দেশীয় চলচ্চিত্র জগতের অবক্ষয় শুরুর সময়ের না বলা একটি ঘটনার কথা তুলে ধরে ববিতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নব্বই দশকের শেষ দিকে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা শুরু হলেও অনেক সিনিয়র নির্মাতা ও শিল্পী এ জগৎ ছেড়ে যাননি।তারা চেষ্টা করেছেন শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এতে কারও সহযোগিতা পাওয়া দূরে থাক, অনেককে লাঞ্ছিত পর্যন্ত হতে হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছিলাম। ২০০৫ সাল। আমি তখন সেন্সর বোর্ডের সদস্য ছিলাম।
শরীফউদ্দিন খান দীপু নামে এক প্রযোজক-পরিচালকের ‘হীরা আমার নাম’ ছবিটিতে মারাত্মক সব অশ্লীল দৃশ্য থাকায় তা ছাড় দিইনি বলে ওই নির্মাতা আমার সঙ্গে চরম অসদাচরণ করে। আমাকে দেখে নেবে বলে কঠিন হুমকি দেয়। নানাভাবে আমাকে লাঞ্ছিত করেছিল। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, তখনকার চলচ্চিত্রকাররা এ ব্যাপারে আমার পক্ষ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করেননি বা কোনো কঠোর অবস্থানে যাননি। তাহলে বুঝতেই পারছেন, সিনিয়ররা যদি উদ্যোগও নেন তাহলে এতে কতটা লাভ বা ক্ষতি হতে পারে। এ কারণেই সিনিয়ররা মানসম্মান বাঁচাতে ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন।
ববিতা হতাশার সুরে বলেন, এই মানহীন অবস্থার সঙ্গে নিজেকে আর জড়াতে চাই না। মানসম্মত কাজ করে যে সুনাম অর্জন করেছি তা রক্ষা করা এখন দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে পৃথিবী থেকে একদিন বিদায় নিতে হবে। চলে যাওয়ার পর কাজের মাধ্যমেই বেঁচে থাকতে হয় মানুষকে।
এত দিন ভালো যা অর্জন করেছি তা ধরে রাখতে চাই। আমি জানি, চলচ্চিত্র শিল্প আজ যে অবস্থায় চলে গেছে, তা পুনরুদ্ধার করা দুঃসাধ্য। উদ্যোগ নিয়েও খুব একটা পজিটিভ রেজাল্ট পাওয়া যাবে না। এমন অবস্থায় অভিনয়ে ফিরব কী করে। নির্মাণেও আসার সাহস পাচ্ছি না। কারণ সিনেমা হলের স্বল্পতা এবং দর্শক প্রায় সিনেমা হল বিমুখ। সেখানে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে কীভাবে এবং কাকে দেখাব।
এখন চলচ্চিত্র প্রদর্শনের নতুন মাধ্যম ওটিটি চালু হয়েছে। যদিও বড় পর্দার বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। তারপরও নতুন ব্যবস্থাকে স্বাগত জানানো যায়। কিন্তু ওটিটিতে সেন্সর বা প্রিভিউর কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সেখানেও অশ্লীলতা ও মানহীন কাজের অভিযোগ উঠেছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে দর্শক সুস্থ বিনোদনের অভাবে হতাশায় নানা অবক্ষয়ের পথে পা বাড়াবে বা দেশীয় কৃষ্টি কালচার বর্জন করবে। সংস্কৃতির ঐতিহ্যঘেরা বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য এটি অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা।