বিশিষ্ট অভিনেতা-নাট্যকার-চিত্রপরিচালক ও লেখক আব্দুল্লাহ আল মামুন-এর ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০০৮ সালের ২১ আগস্ট, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। প্রয়াত এই গুণি ব্যক্তিত্বের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
আব্দুল্লাহ আল মামুন ১৯৪২ সালের ১৩ জুলাই, জামালপুরের আমলা পাড়ায়, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা অধ্যক্ষ আব্দুল কুদ্দুস এবং মা ফাতেমা খাতুন। তিনি ১৯৬৪ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে এমএ পাস করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই জড়িত হন মঞ্চনাটকের সাথে। নাট্যসংগঠন থিয়েটার-এর তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
আবদুল্লাহ আল মামুন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই মঞ্চনাটক রচনা করেছেন। শপথ, নিয়তির পরিহাস ও বিন্দু বিন্দু রং নামে তিনটি নাটক এবং ক্রিস্টোফার মার্লোর ‘ডক্টর ফস্টাস’ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন তিনি। পরবর্তিতে ‘ঋতুরাজ’ শীর্ষক একটি কাব্যনাটকও রচনা করেন ।
আবদুল্লাহ আল মামুন রচিত উল্লেখযোগ্য নাটকসমূহ- সুবচন নির্বাসনে, এখন দুঃসময়, সেনাপতি, এখনও ক্রীতদাস, কোকিলারা, দ্যাশের মানুষ, মেরাজ ফকিরের মা, মেহেরজান আরেকবার, অরক্ষিত মতিঝিল, ক্রসরোড ক্রস ফায়ার, আয়নায় বন্ধুর মুখ, মাইক মাস্টার, ইত্যাদি৷
আব্দুল্লাহ আল মামুন নিজের পেশাগত জীবন শুরু করেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রযোজক হিসেবে। পরবর্তীকালে হন পরিচালক (ফিল্ম ও ভিডিও ইউনিট ১৯৬৬-১৯৯১)।
টেলিভিশনে তাঁর রচিত ও প্রযোজিত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে- সংশপ্তক, ঘরোয়া, আমি তুমি সে, পাথর সময়, জোয়ার ভাটা, বাবা, শীর্ষবিন্দু , জীবন ছবি, উত্তরাধিকার, সাত সমুদ্দুর, সুন্দর সর্বনাশ, যা থাকে কপালে, যার যা ভূমিকা, প্রভৃতি।
শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস ‘সংশপ্তক’ নিয়ে বিটিভিতে ধারাবাহিক নাটক পরিচালনা করে আব্দুল্লাহ আল মামুন অর্জন করেছিলেন প্রবাদপ্রতিম খ্যাতি।
নাটক রচনা ও প্রযোজনার পাশাপশি তিনি একজন তুখর অভিনেতাও বটে। অসংখ্য কালজয়ী নাটকে অভিনয় করেছেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। নায়ক থেকে নিয়ে চরিত্ররাভিনেতা, সবরকম চরিত্রেই তিনি অভিনেতা হিসেবে রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। পেয়েছেন প্রভুত জনপ্রিয়তাও।
নাট্যজন আব্দুল্লাহ আল মামুন চলচ্চিত্র পরিচালনা ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন। তাঁর পরিচালিত ছবি- সারেং বৌ, সখি তুমি কার, এখনই সময়, দুই জীবন, জনম দুখি, দমকা, বিহঙ্গ, দড়িয়া পাড়ের দৌলতি, শেষ বিকেলের মেয়ে, দুই বেয়াইয়ের কীর্তি।
গোলাপী এখন ট্রেনে, এখনই সময়, জনম দুখি, দারুচিনি দ্বীপ, দড়িয়া পাড়ের দৌলতি’সহ বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন আব্দুল্লাহ আল মামুন।
চলচ্চিত্রের অন্যান্য শাখায়ও কাজ করেছেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। অশিক্ষিত, জীবন নিয়ে জুয়া, অঙ্গীকার, মানে না মানা’সহ কয়েকটি ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন তিনি।
লেখক আবদুল্লাহ আল মামুন-এর ৭টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো হলো- মানব তোমার সারাজীবন, আহ্ দেবদাস, তাহাদের যৌবনকাল, হায় পার্বতী, এই চুনীলাল, গুন্ডাপান্ডার বাবা ও খলনায়ক। ‘আমার আমি’ নামে একটি আত্মচরিত এবং ‘ম্যানহাটান’ নামে একটি ভ্রমণ কাহিনী রচনা করেন তিনি। এছাড়াও নাট্যাভিনেতাদের জন্য তাঁর ‘অভিনয়’ (প্রথমখন্ড) নামে একটি শিক্ষামূলক গ্রন্থ রয়েছে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন শিল্প ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন৷ এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-১৯৭৮ সালে জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার- টিভি নির্মাতা (নাটক-সংশপ্তক), বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ পরিচালক (সারেং বৌ), ১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮০ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ পরিচালক (চলচ্চিত্র-এখনই সময়), ১৯৮২ সালে অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার (চলচ্চিত্র -দুই জীবন), ১৯৯১ সালে মুনীর চৌধুরী সন্মাননা-সাহিত্য।
রাস্ট্রীয় সন্মাননা নাট্যকলায়, একুশে পদক- ২০০০। টিভি প্রযোজক, চলচ্চিত্রকার, নাট্যশিক্ষক, নাট্যকার, অভিনেতা, ঔপন্যাসিক ও সংগঠক হিসেবে অসামান্য খ্যাতির অধিকারী ছিলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন।
তাঁর নির্মিত নাটক ও চলচ্চিত্রসমূহ ছিল শিল্পীত ও নান্দনিকতায় মোড়াঁ। নিজের অসাধারণ অভিনয় প্রতিভা ও দক্ষতাও ছিল অত্যন্ত উচমানের ।
বাংলাদেশের মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটক, চলচ্চিত্র, শিল্প-সংস্কৃতিকে প্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর ছিল অগ্রণী ভূমিকা। সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশ ও সংরক্ষন আন্দোলনে নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের কিংবদন্তীতুল্য শিল্প-সংস্কৃতির সৃজনশীল মেধাবী মানুষ, আব্দুল্লাহ আল মামুন স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকবেন অঅনন্তকাল।