স্ববনামধন্য কন্ঠশিল্পী নীলুফার ইয়াসমিন-এর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০০৩ সালের ১০ মার্চ, ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর। বরেণ্য এই সঙ্গীতশিল্পীর প্রতি বিন্ম্র শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
নীলুফার ইয়াসমিন ১৯৪৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে, জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম খান বাহাদুর মোঃ লুৎফর রহমান (সাবেক ডিএম) এবং মাতার নাম মোসাম্মৎ মৌলদা খাতুন (উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী)। তাঁর পৈতৃক বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার মুকুন্দপুর গ্রামে।
পাঁচ বোনদের মধ্যে- ফরিদা ইয়াসমিন, ফওজিয়া ইয়াসমিন এবং সাবিনা ইয়াসমিন এরা সবাই খ্যাতিমান কন্ঠশিল্পী। তাঁর আরেক বোন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নাজমা ইয়াসমিন।
নীলুফার ইয়াসমিনের শৈশব কেটেছে মুর্শিদাবাদ, রাজশাহী এবং ঢাকায়। মায়ের কাছে নিলুফার ইয়াসমিনের সঙ্গীতে হাতেখড়ি৷ বাসায় গ্রামোফোন রেকর্ডপ্লেয়ার ছিল৷ পিতা নতুন নতুন রেকর্ড কিনে আনতেন আর বোনেরা সবাই মিলে সেসব রেকর্ডের গান বারবার বাজিয়ে শুনতেন৷ বিখ্যাত সব শিল্পীদের গাওয়া রেকর্ড থেকে তাঁর মা গান তুলে গাইতেন এবং তাঁর গাওয়া থেকেই নীলুফার ইয়াসমিন গান শিখে ফেলতেন৷
তাঁর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখা শুরু হয়, ওস্তাদ পি সি গোমেজ এর কাছে। তারপর উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ, বড়ে গোলাম আলী খাঁ-র সুযোগ্যা ছাত্রী মীরা ব্যানার্জীর কাছে তালিম নেন৷ এরপর প্রখ্যাত সারেঙ্গী বাদক ওস্তাদ সগীরউদ্দীন খাঁ ও মুরশিদাবাদের স্বনামধন্য ওস্তাদ, এ দাউদ সাহেব ও প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দীর্ঘকাল তালিম গ্রহণ করেন৷
প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী, নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপিকার ও বিশেষজ্ঞ শেখ লুৎফর রহমান ও সুধীন দাশ-এর কাছে নজরুল-সঙ্গীত শিখেছেন তিনি ৷
সঙ্গীত শিক্ষার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়ও নিলুফার ইয়াসমিনের ছিল সমান মনোযোগ৷ বাংলাবাজার গার্লস স্কুল ১৯৬৩ সালে ম্যাট্রিক, সিদ্ধেশ্বরী কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৬৮-তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে বি.এ (অনার্স) এবং ১৯৭০ সালে এম.এ পাস করেন৷
তিনি ১৯৬৯ সালে, প্রখ্যাত অভিনেতা- গীতিকার-সুরকার-সঙ্গীতশিল্পী ও পরিচালক, খান আতাউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন৷ তাঁদের একমাত্র পুত্র কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেতা আগুন।
নীলুফার ইয়াসমিন বাংলাদেশ বেতারের ছোটদের অনুষ্ঠান ‘খেলাঘর’-এ প্রথম গান গাওয়া শুরু করেন৷ পরবর্তীতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে, আমৃত্যু নিয়মিত গান গেয়েছেন৷
উচ্চাঙ্গ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, টপ্পা, ঠুমরি, কীর্তন, রাগপ্রধান, আধুনিক গানসহ, গানের ভুবনে প্রায় সবগুলো শাখাতেই অবাধ বিচরণ ছিল তাঁর।
কন্ঠশিল্পী হিসেবে নীলুফার ইয়াসমিনের জনপ্রিয়তা দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছিল। তিনি বিভন্ন সময়ে ভারতের দিল্লি ও কলকাতায় সঙ্গীত পরিবেশন করে বিপুল জনপ্রিয়তা ও প্রসংশা পেয়েছেন । এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ফ্রান্স, পাকিস্তান ভ্রমণ করেন এবং সঙ্গীত পরিবেশন করে এসব দেশের সঙ্গীতপ্রেমীদের অভিভূত করেন ।
নিলুফার ইয়াসমিন বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন৷ যেমন- অরুণ বরুণ কিরণমালা, জোয়ার ভাঁটা, জীবন থেকে নেয়া, আবার তোরা মানুষ হ, সুজন সখী, যে আগুনে পুড়ি, জীবনতৃষ্ণা, জলছবি, চলো ঘর বাঁধি, শুভদা, ইত্যাদি৷
তাঁর গাওয়া কিছু জনপ্রিয় কালজয়ী গান- আগুন জ্বলেরে নিভানোর মানুষ নাই…, জীবন সেতো পদ্ম পাতার শিশির বিন্দু…, এ আধাঁর কখনো যাবে না মুছে, আমার পৃথিবী থেকে…, তোমাকে পাবার আগে…, এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে…., এতো সুখ আমি সইবো কেমন করে…, পথের শেষে অবশেষে বন্ধু তুমি…, যদি আপনার লয়ে এ মাধুরী…, এতো কান্নাই লিখা ছিলো ভাগ্যে আমার…., যে মায়েরে মা বলে কেউ ডাকে না…, প্রতিদিন সন্ধ্যায়…, মাগো আমার যে ভাই…., এখনো কেন কাঁদিস ও পাখি…., দিওনা দিওনা ফেলে দিওনা…, প্রভৃতি।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে- জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার, সঙ্গীতে অনন্য অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় একুশে পদক-২০০৪ (মরণোত্তর), নজরুল সঙ্গীতে অবদানের জন্য নজরুল পদক’সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন নীলুফার ইয়াসমিন।
১৯৯৫ থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের নজরুল সঙ্গীত বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন৷ তাঁর অনন্য অবদানের কথা চিরস্বরণীয় করে রাখতে তাঁর নামে নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগে পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে।
বাংলা গানের স্নিগ্ধময়ী এক কন্ঠশিল্পী ছিলেন নীলুফার ইয়াসমিন। বিভিন্ন ধারার সঙ্গীতের উপর ছিল তাঁর অগাধ দখল। তিনি তাঁর সুরেলা কন্ঠমাধুর্যে সঙ্গীত বোদ্ধাদের অভিভূত করেছেন অনায়াসে। দেশবরেণ্য এই শিল্পী, চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন সঙ্গীতপ্রেমীদের মাঝে।