নাসিম রুমি: ঝর্ণা বসাক। বাংলাদেশের প্রখ্যাত একজন অভিনেত্রী। যিনি শবনম নামে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। শবনম নামের অর্থ ফুলের মধ্যে বিন্দু বিন্দু শিশির ঝরে পড়া। একজন হিন্দু অভিনেত্রী হিসেবে পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন শবনম। বাংলাদেশে তিনি ‘আম্মাজান’ সিনেমাটির জন্য বিখ্যাত।
১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৮০’র দশক পর্যন্ত একাধারে সক্রিয় অভিনয় চর্চা করে গেছেন প্রবীণ এই অভিনেত্রী। ৯০-এর দশক থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী শবনম ওই সময় অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ও রোমান্টিক নায়িকা হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম- উভয় অংশেই সমান জনপ্রিয় ছিলেন।
১৯৪৬ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন ঝর্ণা বসাক ওরফে শবনম। সেই হিসেবে আজ ৭৭ পেরিয়ে ৭৮ বছরে পা দিলেন শবনম। তার বাবা ননী বসাক ছিলেন একজন স্কাউট প্রশিক্ষক ও ফুটবল রেফারি। স্বনামধন্য সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষকে শবনম বিয়ে করেন ১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর। ২০১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি গুলশানে নিজ বাসায় বার্ধ্যক্যজনিত কারণে মারা যান অভিনেত্রীর স্বামী।
শভনম ও রবিন ঘোষ দম্পতির সংসারে একটি পুত্রসন্তান রয়েছে, নাম রনি ঘোষ। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে বর্তমানে ঢাকার একটি অভিজাত এলাকায় বসবাস করেন এই অভিনেত্রী।
শৈশবেই বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে নাচ শিখেছিলেন শবনম। একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে তিনি সুপরিচিতি ছিলেন। সেখানেই একটি নৃত্যের অনুষ্ঠানে পরিচালক এহতেশাম তার নাচ দেখে ‘এদেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রের নৃত্যে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। তিনি আরও কিছু ছবিতে অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন।
কিন্তু অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেই এহতেশামের পাশাপাশি পরিচালক মুস্তাফিজের নজর কাড়তেও সক্ষম হন শবনম। মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে ১৯৬১ সালে নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন শবনম। এ ছবিতেই তিনি শবনম নাম ধারণ করেন। জনপ্রিয়তাও পান।
১৯৬২ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘চান্দা’ ছবির মাধ্যমে তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে রাতারাতি তারকাখ্যাতি পান শবনম। দুটি ছবিই তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ঢাকা থেকে মুক্তি পেয়েছিল। পরবর্তী বছরে ‘তালাশ’ সমগ্র পাকিস্তানে মুক্তি পেলে ওই সময়ের সর্বাপেক্ষা ব্যবসা সফল ছবির মর্যাদা লাভ করে।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে শবনম পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় অভিনেত্রী হিসেবে চিহ্নিত হন। পেশাজীবি মনোভাবের কারণে তিনি ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের করাচীতে স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন। সত্তর দশকের শুরুতে শবনম পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করেন।
নায়িকা হিসেবে পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে ধ্বস নামার পূর্বে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন শবনম। সম্ভবতঃ বিশ্বে তিনিই একমাত্র চলচ্চিত্র অভিনেত্রী, যিনি ১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত তিনটি দশক ধারাবাহিক ও সফলভাবে রোমান্টিক চরিত্রে অভিনয় করে অগণিত দর্শক-শ্রোতার মন জিতেছিলেন।
শবনম সে সময় ‘আয়না’ নামে একটি ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন এবং সেটি পাকিস্তানের সিনেমা হলগুলোতে দীর্ঘদিন চলার রেকর্ড করে। ৬০-এর দশকে কাজী রিজভানীর পরিচালনায় ওয়াহিদ মুরাদের বিপরীতে ‘লাদলা’ ছবির ‘সোচা থা পিয়ার না করেংগে’ গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পায় এবং সেই সাথে শবনমও সবার কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হন।
১৯৮৮ সালে শবনম তার চরিত্র পরিবর্তন করেন এবং পুনরায় ঢাকা ও লাহোরের চলচ্চিত্রাঙ্গনে অভিনয় করতে থাকেন। ৪০ বছরের বেশি সময়ের ক্যারিয়ারে তিনি ১৮০টির বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, যার বেশিরভাগই জনপ্রিয়।
শবনম অনেকবার সম্মানসূচক নিগার পুরস্কারের পাশাপাশি তিনবার পাকিস্তানের জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছেন। কাজী হায়াতের পরিচালনায় ও ঢাকা প্রোডাকশনের ব্যানারে তিনি ১৯৯৯ সালে সর্বশেষ ‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। এই সিনেমা দেশব্যাপী সুনামি সৃষ্টি করেছিল। বর্তমানে তিনি ‘আম্মাজান’ নামেই সর্বাধিক পরিচিত।