ঠাকুরগাঁওয়ের ইত্যাদি প্রচারের আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায়, এমনকি দেশের মূল ধারার চ্যানেলে-পত্রিকায় অনুষ্ঠানস্থলে হামলা-ভাঙচুরসহ অনুষ্ঠান ধারণ বন্ধ বলে সংবাদ প্রচারিত হয়। যদিও হানিফ সংকেতের বক্তব্যের পরে অনেকেই এ সংবাদটি প্রত্যাহার করেছেন। অর্থাৎ এটি যে এক ধরনের গুজব ছিল সেটার প্রমাণ পাওয়া গেল ৩১ জানুয়ারি ইত্যাদি প্রচারের পর।
৩৭ বছরে এসেও হানিফ সংকেত ও তাঁর ইত্যাদি কত জনপ্রিয় তার প্রমাণ পাওয়া গেল আবারও। টিভিতে দেখা গেল বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো দর্শক আসছেন অনুষ্ঠানস্থলে। একটি গাছ দেখে মনে হলো গাছের পাতাগুলো যেন মানুষ দিয়ে সাজানো। অনুষ্ঠানে দর্শকদের ঢেউ ছিল লক্ষণীয়। অনুষ্ঠান দেখে বোঝা গেল ধারণ ক্ষমতার বাইরে দর্শকদের এ বিশাল উপস্থিতি ও শোরগোলের মধ্যেই ধারণ করা হয়েছে ইত্যাদির ঠাকুরগাঁও পর্ব। ইত্যাদির এ দীর্ঘ যাত্রায় দর্শকদের ভালোবাসা-ভালোলাগা-সমর্থন-সহযোগিতার কথা স্মরণ করে ইত্যাদি পরিবারের পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ জানালেন হানিফ সংকেত।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই ছিল ঠাকুরগাঁও জেলার ওপর একটি তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন। যার মাধ্যমে পুরো ঠাকুরগাঁওকে তুলে ধরা হয়েছে। এ পর্বে ঠাকুরগাঁওয়ের কৃতী সন্তান হিসেবে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয় রাজনীতিতে ক্লিন ইমেজের পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত সজ্জন ব্যক্তি ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। হানিফ সংকেত যে আসলেই একজন অত্যন্ত সচেতন এবং নির্দলীয় ব্যক্তি তার এ সাক্ষাৎকারে সেই চিত্র ফুটে উঠেছে। শুরুতেই বলেছেন, সাক্ষাৎকারটি রাজনীতিমুক্ত।
তিনি তাঁর অজানা কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন। তাঁর এ ছোট অথচ বৈচিত্র্যময় ও উপভোগ্য সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সংস্কৃতিপ্রীতি, তাঁর অভিনয়, নির্দেশনা, আবৃত্তিসহ নানান বিষয়। এ সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সততাই হচ্ছে একজন জনপ্রতিনিধির প্রধান গুণ। তিনি ইত্যাদি এবং হানিফ সংকেতের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ইত্যাদি তাঁর অত্যন্ত প্রিয় অনুষ্ঠান। শুধু বাড়িতেই নয় জেলখানায় থাকা অবস্থায়ও সবাই মিলে এ অনুষ্ঠানটি দেখতেন। রাজনীতিমুক্ত এ চমৎকার সাক্ষাৎকারটি নেওয়ার জন্য হানিফ সংকেতকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।
এবারের ইত্যাদিতে ছিল প্রায় শতাধিক নৃত্যশিল্পীর নৃত্য আর গানে ঠাকুরগাঁওয়ের পরিচিতি। মূল গান গেয়েছেন শিল্পী রবি চৌধুরী ও লিজা। লিটন অধিকারী রিন্টুর কথা ও কিশোর দাসের সুরে গানটি ছিল উপভোগ্য। অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত লোকায়ন জীবনবৈচিত্র্য জাদুঘরের স্লোগান ছিল ‘অস্তিত্বের সন্ধানে, শিকড়ের টানে-লোকায়ন জীবনবৈচিত্র্য জাদুঘর।’ জাদুঘর বলতে আমরা যা বুঝি এটি তেমন নয়। জাদুঘরটিতে রয়েছে ছয়টি স্বতন্ত্র্য গ্যালারি। জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা জানালেন, ইত্যাদিতে প্রচারের পর সেখানে দর্শনার্থীর ভিড় বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে।
শুধু তাই না, টাঙ্গুয়ার হাওর পেরিয়ে ২০১৮ সালে টেকেরঘাটে একটি ইত্যাদি করা হয়। তখন সেখানে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো ছিল না। কিন্তু ইত্যাদি প্রচারের পর টাঙ্গুয়ার হাওর এবং টেকেরঘাট একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়। আর সেজন্যই এখানে গড়ে উঠেছে সুদৃশ্য হাউসবোট। শুধু তাই নয়, মধ্য সাগরে এক অভিনব ভাসমান দোকানও দেখানো হয় এবারের ইত্যাদিতে। চলতি পথে রসদ ফুরালেই এসব দোকানে ভিড় জমান মাছ শিকারি জেলেরা।
গাইবান্ধার প্রবীণদের সংগঠন ‘বেলা শেষের যাত্রী’র সদস্যদের সঙ্গে হানিফ সংকেতের আলোচনা ছিল অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ। প্রবীণ সদস্যরা বললেন, নিজেদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করার জন্যই বাজারের একটি ঘরকে তারা ভাড়া নিয়েছেন। সংগঠনের সবাই সমস্বরে ইত্যাদির প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে বললেন, এখন অবসরে ইত্যাদিই তাদের প্রিয় অনুষ্ঠান।
সেই ১৯৯৯ সালে হলিউডের ইউনিভার্সেল স্টুডিওতে ধারণ করা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ইত্যাদিতে প্রথম প্রচারিত হয় বিদেশি পর্ব। তারই ধারবাহিকতায় এবার দেখিয়েছেন বেইজিংয়ে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সমাবেশস্থল তিয়েনআনমেন স্কয়ার। এখান থেকেই ১৯৪৯ সালে মাও সে তুং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন।
সবশেষে মানসিকভাবে অসুস্থ ও দুস্থ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে এগিয়ে আসা টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের পল্লী চিকিৎসক ঝন্টু বড়ুয়ার ওপর নির্মিত প্রতিবেদনটি ছিল মর্মস্পর্শী। মানবিক দায়বোধে মানুষের প্রতি মানুষের মানবিক আচরণের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন ঝন্টু বড়ুয়া। দেশের সর্ব দক্ষিণের শেষ ইউনিয়ন সাবরাংয়ের পথে-ঘাটে কয়েক শ মানসিক রোগীকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়।
ঝন্টু বড়ুয়া তার স্বল্প আয় থেকে কিছু অর্থ বাঁচিয়ে এসব রোগীর খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি ৪১ জন রোগীকে সুস্থ করে পরিবারের কাছে ফিরিয়েও দিয়েছেন। ইত্যাদির মাধ্যমে কেয়া কসমেটিকসের পক্ষ থেকে এ পল্লী চিকিৎসকের এ শুভ উদ্যোগ আরও এগিয়ে নেওয়ায় সহায়তা করার জন্য দুই লাখ টাকাও প্রদান করা হয়।
এছাড়াও এবারের ইত্যাদিতে ছিল ডজনখানেক বিদ্রুপাত্মক সময়োপযোগী নাট্যাংশ। জ্যোতিষীর পর্বে কারও ভবিষ্যৎ বলতে না পারা, বিবাহবার্ষিকীতে একাল-সেকাল তুলে ধরা, দম্পতির নির্লজ্জ ইউটিউব ব্যবসা, পাত্রী নির্বাচনে ইউটিউব শিক্ষা নয় পারিবারিক শিক্ষার গুরুত্ব, একটি সালিশ অনুষ্ঠানের বিচারকের সন্তানই চাঁদাবাজ, সময়ের পরিবর্তনে নতুন পোস্ট ও পুরনো পোস্ট নিয়ে বইমেলায় অভিনব বই ‘পোস্ট চিরন্তনী’র প্রকাশ ছিল উপভোগ্য। এবার নাতির সঙ্গে নানি নয়, দেখা গেছে নাতির সাক্ষাৎকার নিয়েছে ইত্যাদির জনপ্রিয় কাশেম টিভির রিপোর্টার। চমৎকার আইডিয়ায় নির্মিত পর্বটি ব্যতিক্রমী হওয়ায় ভালো লেগেছে।
ভালো লেগেছে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জের বাসিন্দা জুয়েলের অরেঞ্জ ভ্যালির হলুদ বর্ণের মাল্টা ও কমলার চাষ। তবে এবারের ইত্যাদি আগে থেকেই আলোচিত ছিল বলে টিভিতে দেখার পর লেখার জন্য আবারও ইউটিউবেও দেখেছি। একটা বিষয়ে খটকা লাগল- ভারতীয় একটি চ্যানেলের বাংলাদেশবিদ্বেষী নিন্দিত ও ঘৃণিত এক সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার দেখলাম ইত্যাদির ইউটিউবে। কিন্তু বিটিভিতে সেই সাক্ষাৎকারটি ছিল না। এর কারণ কি ঠিক বুঝলাম না। বিটিভিতে কী এখনো ভারতীয় সংস্কৃতি লালনের প্রেতাত্মা রয়েছে? নাকি নব্য প্রিভিউ কমিটির কাঁচির শিকার হয়েছে? নইলে এত সূক্ষ্ম এবং নান্দনিক সময়োপযোগী স্যাটায়ারমূলক নাট্যাংশটি কেন বিটিভিতে প্রচার হলো না সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। অথচ ইত্যাদির নাট্যাংশটিই সোশ্যাল মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি ভাইরাল হয়েছে।
পরিশেষে একটি চমৎকার ইত্যাদি উপহার দেওার জন্য হানিফ সংকেত ও ইত্যাদির টিমকে অভিনন্দন।