বাংলাদেশ ও ইরানের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছে অনন্ত-বর্ষার সিনেমা ‘দিন: দ্য ডে’। শুরু থেকেই জানা গেছে, সিনেমাটির বাজেট ১০০ কোটি টাকা। বাজেটের কারণে মুক্তির বহু আগে থেকেই আলোচনার কেন্দ্রে ছিলো সিনেমাটি। কিন্তু সিনেমাটির নির্মাতা মোর্তেজা অতাশ জমজম জানালেন, ‘দিন: দ্য ডে’র প্রকৃত বাজেট পাঁচ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ কোটি ৭৪ লাখ ৯৭ হাজার ৩৩০ টাকা।
‘দিন: দ্য ডে’র বাজেটের চুক্তিপত্রটি নিজের ইনস্টাগ্রামে প্রকাশ করেছেন ইরানি পরিচালক ও এই সিনেমার সহ-প্রযোজক মোর্তেজা অতাশ জমজম।
এছাড়াও সেই পোস্টে বাংলায় একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছেন। বিবৃতিটি তুলে ধরা হলো-
বাংলাদেশের অগণিত সংস্কৃতিমনা প্রিয় মানুষ ও মিডিয়া ব্যাক্তিত্বদের ভালোবাসা মিশ্রিত ক্ষুদে বার্তা ও সহযোগিতায় আমি অভিভূত। আমি বিশ্বাস করি সংস্কৃতির নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ কোনো প্রকারের জাতীয়তা ও কাঁটাতারের সীমানায় আবদ্ধ থাকে না। বিভিন্ন মাধ্যমে যেসব বন্ধুরা আমাকে বার্তা পাঠিয়েছেন, আমি এবং আমার ইরানি টিমের পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। প্রত্যেকের বার্তার জবাব দিতে পারিনি, সে জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
এই চার বছরে, আমি নিরবে ও সম্মানের সঙ্গে এই প্রকল্পটি ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এখন আমি জনাব অনন্ত জলিলের অভিযোগগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের কাছে, সংক্ষিপ্তাকারে, কিছু বিষয় উপস্থাপন করতে বাধ্য হচ্ছি। কয়েকজন বন্ধু উনাকে বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান সুপারস্টার হিসেবে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
জনাব অনন্ত জলিল তার আগের নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর ভিডিও ফুটেজ ও মানুষের অভ্যর্থনা ভিডিওচিত্র দেখানোর মধ্য দিয়ে আমাকে বলেন যে, তার সর্বশেষ মুভিটি প্রায় দুই মিলিয়ন ডলার বিক্রি হয়েছে। উনার সর্বশেষ মুভিটি দেখার পর আমার বিশ্বাস ছিল যে, পেশাদার ইরানি টিম নিয়ে আমরা এর থেকেও আরও অনেক অনেক ভালো একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারব। যার ফলে আমি এই প্রকল্পটি গ্রহণ করেছিলাম। অবশ্য, আমার জন্যও ইরানের পরিবেশে একটা ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণ করা চ্যালেঞ্জিং ও আকর্ষণীয় ছিল।
ডে চলচ্চিত্রের চুক্তিপত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল যে, জনাব অনন্ত জলিলের অর্থায়নে সিনেমাটি তৈরি হবে (কারণ এই ধারার চলচ্চিত্র ইরানের জনগনের পছন্দের না)। এবং সেই সঙ্গে চুক্তিপত্রে স্পষ্টতঃ তার নামটি এই চলচ্চিত্রের বিনিয়োগকারী ও অভিনেতা হিসেবে, এবং আমার নামটি প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে।
চলচ্চিত্রটির চুক্তি ও বাজেটের পরিমাণ $৫০০,০০০ (পাঁচ লক্ষ মার্কিন ডলার) ছিল। অর্থাৎ আমরা ইরানি টিম কাজ করব এবং তিনি টাকা খরচ করবেন। এবং পরিশেষে চলচ্চিত্রের লভ্যাংশের ৮৫% বিনিয়োগকারীকে ও ১৫% প্রযোজক হিসেবে আমাকে দেয়া হবে। অবশ্য, আপনারা ডে সিনেমার বাজেট ঘোষণায় উনার দাবির পরিমাণ স্পষ্টভাবে দেখে থাকবেন। তিনি ডে সিনেমার নির্মাণ ব্যয় দশ মিলিয়ন ডলার প্রচার করেছেন। যদিও তিনি এখন পর্যন্ত খরচের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাঁচ লাখ মার্কিন ডলার পুরোটা পরিশোধ করেননি। যেখানে কি-না দশ মিলিয়ন ডলারের দাবী, মূল বাজেটের প্রায় ত্রিশ গুণ বেশি দাবি!
দুর্ভাগ্যবশত, শুটিং শুরুর দিনগুলোতে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এটি আমি আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু চুক্তির কারণে আমার ফিরে আসার কোনো পথ ছিল না। আমি চাইনি আমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়ে যাক। উনার ক্রমাগত স্ক্রিপ্ট পরিবর্তন, যেমন- গল্পে আইএস জঙ্গিবাদ ইস্যু থেকে মাদক ও মাফিয়া ইস্যুতে পরিবর্তন, চিত্রায়ণের স্থান সিরিয়া ও লেবানন থেকে পরিবর্তন করে আফগানিস্তান ও তুরস্কে নিয়ে যাওয়া, এইসবের মধ্য দিয়ে আমাদের মতপার্থক্যের শুরু হয়। যেহেতু চলচ্চিত্রটির ৮৫% বাংলাদেশের এবং তিনি বলতেন বাংলাদেশের সিনেমা ও মানুষদের আমার চাইতে ভালো জানেন, এই অজুহাতে প্রতিদিন চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্টে ও অভিনয়ে হস্তক্ষেপ করতেন।
সিনেমায় তার হস্তক্ষেপ ছাড়াও চিত্রগ্রহণের দিনগুলোতে বিলম্ব ঘটাতেন (তার ব্যবসা ও কারখানায় কাজের চাপের অজুহাতের কারণে চিত্রগ্রহণের সময়-সূচী পরিবর্তন করতে হত), তিনি আমাকে সম্পূর্ণ এবং সময়মতো চলচ্চিত্রে বাজেটের টাকাও পরিশোধ করতেন না। এবং এই কারণে চলচ্চিত্রের কাজে আমার ঋণ ও চিত্রগ্রহণের ব্যয় প্রতিদিন বেড়ে চলছিল। দিনের পর দিন তার কারণে ব্যয় বেড়েই যাচ্ছিল। তার অদ্ভুত ও অপেশাদার আচরণ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, আমি তাকে বলেছিলাম ও লিখেছিলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত উনি ঋণ পরিশোধ না করবেন, আমি প্রকল্পটির কাজ আর চালাব না।
উনি আমার ঋণ পরিশোধ ছাড়া ও অনুমতি ব্যতীত, নিজে অপেশাদারিত্ব দেখিয়ে চলচ্চিত্রটির প্রযোজক ও পরিচালক সেজে তুরস্কে চিত্রগ্রহণ করেছেন। এমনকি এখন আমি লক্ষ্য করেছি যে, তিনি তুরস্কের কিছু চিত্রায়ণে নারীদের অশালীন নৃত্য দেখিয়েছেন। যা কি-না সম্পূর্ণ চুক্তির বিরুদ্ধে। কারণ চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলোর মধ্যে একটি হলো দুই দেশের আইনকে সম্মান করা। কিছুদিন কাজ বন্ধ থাকার কিছু সময় পর কয়েকজন বন্ধুর মধ্যস্ততায় আমাদের মধ্যে সমঝোতা হয়। এবং তিনি আমাকে মৌখিক ওয়াদা দেন যে, ভাই! আমি আপনার টাকা পরিশোধ করব। যেহেতু আমিও ইরানের চলচ্চিত্র কলাকুশলীদের কাছে অনেক ঋণগ্রস্থ ছিলাম, তাই আমাকে পুনরায় তার বন্ধুত্বের উপর আস্থা রাখতে হয়েছে।
পরবর্তীতে, তিনি আমাকে টাকার আশ্বাস দিয়ে দুই দফা ভারতের হায়দ্রাবাদে ও বাংলাদেশে নিয়ে যান। এবং বাংলাদেশে দুই লক্ষ মার্কিন ডলারের পরিবর্তে চব্বিশ হাজার মার্কিন ডলার দেনা পরিশোধ করেন, যার স্বাক্ষী-প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে এবং আমি তা সময় মতো আদালতে উপস্থাপন করব। আমি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ট্রেইলার প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে যারপরনাই বিব্রত ও লজ্জিত হয়েছি। তখন জনাব অনন্ত জলিল আমাকে পুনরায় নতুন করে ট্রেইলার তৈরির প্রতিশ্রুতি দেন।
এক মাস পরে কিছু ভিজ্যুয়ালের অংশ আমাকে ই-মেইল করলে আমি প্রতি উত্তরে বলেছিলাম, অনেক শিশুসুলভ হয়েছে! আমি উনার কাছে পুনরায় পাওনা টাকা চাইলে, তিনি করোনা ও কোম্পানির লোকসান দেখিয়ে, পরিশোধ করা হতে বিরত থাকেন। আমার কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছে, কেন এতোদিন চুপ ছিলাম? আমি চুপ ছিলাম, কারণ তার বাসায় একসঙ্গে বসে খেয়েছি, সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে। এমনকি চলচ্চিত্রটি মুক্তির আগের দিন, উনাকে এবং উনার স্ত্রীকে ভাই ও বোনের মতো করে আবদার করেছি যেন, আমার পাওনা টাকা দিয়ে দেয়া হয়। আমি যেন কয়েক বছরের ঝামেলা থেকে পরিত্রাণ পাই, আরও বলেছি যেন আমার নামটা এই চলচ্চিত্র থেকে মুছে দেয়া হয়।
দুঃখজনকভাবে, উনার প্রচারের জন্য, নিজের স্বার্থের জন্য, কারও সন্তুষ্টি উনার জন্য মূখ্য ছিল না। চলচ্চিত্র রিলিজের সময়ও নীরব ছিলাম, যেন সম্ভাব্য ব্যর্থতার দায় আমার ঘাড়ে না চাপে। এখনও তিনি তার মিলিয়ন ডলারের মিথ্যাগুলোর মতো, নতুন নতুন দাবি প্রকাশের মধ্য দিয়ে উনার ওয়াদা খেলাফের প্রবনতাকে শত্রুতায় রূপ দিতে চাচ্ছেন। উনি হয়তো জানেন না যে, বাংলাদেশ আমার জন্য দ্বিতীয় ঘরের মতো। যেখানে আমার অসংখ্য প্রানপ্রিয় ভাইবোন ও বন্ধুরা থাকেন। আমার হৃদয়ের অনুভূতিগুলো বাংলাদেশের সন্মানিত অতিথিপরায়ণ, সংস্কৃতি বান্ধব মানুষদের জন্য প্রেরণ করছি। দয়া করে আপনারা আমার মতো, অনন্ত জলিল সাহেবের মিথ্যার সাম্রাজ্য দ্বারা প্রতারিত হবেন না।