জাহারা মিতু: হাসপাতালের বাইরে গাড়িতে বসে আছি। বসন্তের বাতাস এমনিতেই ভালো লাগে। তার মধ্যে পাশেই বড় বড় আমগাছ। গাছ কিংবা ফুল আমার কতোটা প্রিয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গাছজুড়ে নতুন মাত্র গজানো আমের মুকুল। মাঝে মাঝে আমের মুকুলকে আমার ফুল হিসেবে স্বীকৃতি দিতে মন চায় না। আমার ধারণা আমি একটু সেকেলে, তাইতো সেকেলের মানুষগুলোও আমফুলকে ফুল না বলেই হয়তো আমের মুকুল নাম দিয়েছিলেন।
খেয়াল করলে দেখা যায় আর কোনো ফুলকে কিন্তু মুকুল বলা হয় না; হলে কেমন হতো গোলাপ মুকুল, জবা মুকুল, গন্ধরাজ মুকুল। তবে সবথেকে সুন্দর হতো বকুল মুকুল। একটি ফুলের ছোট্ট নামে একটা আস্ত তাল মেলানো ছড়া। বাহ ভালোইতো। আজ থেকে তাহলে আর কেউ ডাকুক আর না ডাকুক আমি বকুল ফুলকে, বকুল মুকুলই বলবো।
আমের মুকুলে ফিরে আসি। আম বাগানে গেলে আমের মুকুলের একটা ঘ্রাণ নেশার মতন মস্তিস্কে ঘিরে ফেলে। জীবনে কখনো নেশা করিনি তাই আমের মুকুলের প্রকাণ্ড ঘ্রাণ ঠিক কোন নেশার মতন বলতে পারছি না। একটা কাজ করলে কেমন হয়?
নেশা করে এমন কোনো মানুষকে কখনো আমের বাগানে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে অবশ্য এই পরীক্ষাটা করা যেতে পারে। একটু পর তাকে বলবো, “বলোতো ভাইয়া, এই ঘ্রাণটা ঠিক কোন নেশার মতন লাগছে?”
এই ভাবনা ভাবতেই আরেকটা কথা মনে পড়লো: নেশাখোর ভাইয়াই হবে এমন কেনো কথা কোথাও নেই। নেশাখোর আপুও হতে পারে। তবে সমস্যা হলো সব নেশাখোর আপুদের মধ্যেই একটা ভাই ভাই ভাব লুকিয়ে থাকে। এরা নিজেদের দমিয়ে রাখার মতন স্বভাব নিয়ে জন্মায় না। চিন্তা করে দেখেন তো কোনো নরম স্বভাবের, সমাজের চোখে আদর্শনারী সুলভ আচার-আচরণ ও ব্যাপার-স্যাপার আছে এমন কাউকে নেশা করতে দেখেছেন? নাহ এমনটা হয় না, তাহলে এই সূত্র মোতাবেক নেশাখোর আপুদের মাঝে মাঝে ভাইয়া ডাকাই যায়।
তবে নেশাখোর ভাইয়া হলে সুবিধা আছে তারা খুব ভালো উত্তর দেয়। আল্লাহ যখন পুরুষ মানুষ বানিয়েছেন তার মন মতন বানিয়েছেন, কিন্তু নারীদের তৈরী করেছেন আদম (আ:) নিঃস্ঙ্গতা দূর করতে পাজরের বাঁকা হাড় থেকে। তাই স্বভাবগতভাবেই নারীরা বাঁকা উত্তর দিবে এটাই স্বাভাবিক। আর ঐ নেশাখোর আপুরা যতই ভাইয়াসুলভ কার্যক্রম করার চেষ্টা করুক না কেনো; আদতে তারা যে নারী তা থেকে তারা কখনোই বের হতে পারবেন না।
আর এই পরীক্ষার পেছনে বারবার সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। তাই এই নেশা পরীক্ষামূলক কার্যক্রম কোনো ভাইয়াকে দিয়েই করার মনোবস্ত করা হলো। কিন্তু আশে পাশে সঞ্জয় দত্ত টাইপ কোনো ভাইয়া খুঁজে পাচ্ছি না যে জীবনে সব নেশা করেছে, এবং আমের মুকুলের কড়া ঘ্রাণ কোন নেশার মতন তা বলতে পারবে। আপনাদের কারো চেনা থাকলে বলতে পারেন আমাকে।
এমন ভাবনা যার মাথায় ঘুরতে থাকে তার মনটা আসলে এখন খুব ফুরফুরে আছে এটাই মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মেজাজ অত্যন্ত চড়া।
প্রেমিকের জন্য অপেক্ষাটা মধুর হলেও হতে পারে, কিন্তু ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা মোটেও সুখকর না। রাস্তা খালি থাকায় আজ “ডাক্তার আসিবার বহু পূর্বেই রোগী পৌঁছিয়া গিয়াছে” টাইপ অবস্থা আমার। ডাক্তারের দোষ নেই, আমারো দোষ নেই, কিন্তু রাস্তার দোষ আছে। প্রতিদিন এতো জ্যাম থাকে, আজ কেনো খালি? নাহ মাথাকে আর চাপ দেয়া ঠিক হবে না।
মস্তিস্ককে আবারও আমের মুকুলের দিকে ঠেলে দিলাম। ঢাকা শহরে অনেক আমগাছ একসাথে হবে এবং সেখান থেকে মুকুলের ঘ্রাণ টের পাবো এটা যেমন দুর্লভ, কোনো কোকিল সুরেলা কণ্ঠে গান গাইছে আর তিড়িং বিড়িং করে আম গাছ জুড়ে নেচে বেড়াচ্ছে এই দৃশ্যও দুর্লভ। তবে এই দুর্লভ দৃশ্যটাও আজ চোখে পড়লো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কোকিলটা নিজের সুরের তালে নিজেই তাল মেলাতে পারছে না।
তার শিষ বাজায় একদিকে, নাঁচে অন্যদিকে। মনে হচ্ছে বেটা কোকিলের কান ধরে নাচটা শিখিয়ে আসি। এতো কম তাল জ্ঞান নিয়ে কেউ নাচ করে? এই রে কোকিলের কান পাবো কোথায়? পেলেও ধরবো কীভাবে? আমার হাতের আঙ্গুলের দিকে তাকালাম, এই আঙ্গুলগুলো যদি কোকিলের কান ধরে, কোকিলকি আসলেই আর কখনো নাচার অবস্থায় থাকবে? কোকিলের কানটা আরেকটু বড় হলে কি হতো?
এসব আবোল-তাবোল ভাবনা যতই ভাবছি মেজাজ আরও খারাপ হচ্ছে। বসন্তের বাতাস খাওয়ার ইচ্ছা আপাতত মূলতবি ঘোষণা করা হলো। গাঁড়ির স্বচ্ছ গ্লাস উঠছে মনে মনে বলছি, “আল্লাহ দয়া করে আমার মেজাজ ঠাণ্ডা করে দাও, প্লিজ…” এমন সময় পাশ থেকে এক লোক হেঁটে যাচ্ছে আর বলছে, “কোনো চিন্তা করবেন না, ওকে ভর্তি করছি। ডাক্তার রক্ত নিয়ে গেছে, রক্ত দিয়ে করোনা টেস্ট করবে তারপর জানাবে কি করা যায়।” আমি ফিক করে হেসে দিলাম।
রক্ত দিয়ে করোনা টেস্ট করার এই নতুন পদ্ধতি আমার জানা ছিলো না। ভাইজান একটা উপকার করলেন নিজের অজান্তে আমাকে এটা জানিয়ে, তবে রোগীর জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে, এই লোক সাথে থাকলে তার চিকিৎসার বারোটা বাজে কিনা তা ভেবে।
মেজাজ এখন একদম ঠাণ্ডা। ডাক্তার আরও পরে আসলেও সমস্যা নেই। যেই হাসপাতালে রক্ত দিয়ে করোনা টেস্ট করে, তার চিকিৎসা নেওয়ার জন্য আমি অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারি।
ওই করোনা টেস্টকিটের খোঁচা খাওয়ার থেকে রক্ত দেয়া অনেক সহজ। গ্লাসটা আবারও নামানো শুরু করলাম, কোকিলটার ভুলভাল নাচের দিকে আবারো মনোযোগী হলাম। দেখি কোকিলটার নাচের উন্নতি হলো কিনা…
বি:দ্র: হাবিজাবি লিখি। থাকুক না কিছু স্মৃতি ফেবুর পাতায়
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)