আজাদ আবুল কাশেম: সৃজনশীল নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যগুরু জি.এ মান্নান-এর ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৯০ সালের ১ মার্চ, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। প্রয়াত এই নৃত্যশিক্ষক-এর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী জি.এ মান্নান (গাজী আলিমুদ্দিন মান্নান) ১৯৩০ সালের ৮ জুন, কুমিল্লার শাকতলায়, জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম মোঃ আলিম উদ্দিন এবং মাতার নাম মোসামৎ কুলসুম বেগম।
তিনি সর্বপ্রথম নৃত্যে তালিম নেন শ্যামাপদ ভট্রাচার্যের কাছে। পঞ্চাশের দশকের আরেক প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও পরিচালক, শান্তি বর্ধনের আহবানে তিনি মুম্বাই চলে যান। সেখানে দীর্ঘদিন তাঁর সান্নিধ্যে থেকে নৃত্যকলায় প্রশিক্ষিত হন। উচ্চাঙ্গনৃত্যে, বিশেষত আসামের মুনিপুরী নৃত্য শিক্ষা গ্রহন করেন। মুম্বাই থাকাকালে তিনি ‘মনীষ কুমার’ (ছদ্ম নাম) নামে বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শান্তি বর্ধনের ‘লিটল ব্যালে গ্রুপের’ অন্যতম সদস্য হিসেবে তিনি ভারতীয় জাতীয় সাংস্কৃতিক দলের হয়ে- চীন, রাশিয়া, পশ্চিম জার্মানী, পোল্যান্ড, নেপালসহ বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেন।
পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে জি এ মান্নান, মুম্বাই থেকে ঢাকা ফিরে আসেন। লোকনৃত্যের সঙ্গে উচ্চাঙ্গনৃত্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নৃত্যনাট্যে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন তিনি। তখন তাঁর খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। বুলবুল ললিতকলা একাডেমির (বাফা) নৃত্যশিক্ষক থাকাকালিন তিনি কতগুলো খন্ডনৃত্য রচনা করেন। যেমন- ময়ূর, বসন্ত, জেলে, ধানকাটা, সাঁওতাল, চা-বাগান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব নৃত্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে জি এ মান্নান তাঁর প্রতিভা ও কৃতিত্বের পরিচয় দেন। একজন সৃজনশীল নৃত্য পরিচালক হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
তাঁর খ্যাতির বিস্তৃতি যখন সর্বত্র, তখনই তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমী ছেড়ে নিজে ‘নিক্বণ ললিতকলা একাডেমী’ নামে একটি নৃত্যপ্রতিষ্ঠান গঠন করেন ঢাকার শান্তিনগরে। এখান থেকে তিনি তৈরি করেন, আবহমান বাংলার অন্যতম লোকগাথাভিত্তিক ‘মহুয়া’ সমসাময়িক কাহিনীভিত্তিক ‘কাশ্মীর’, ‘অধিক খাদ্য ফলাও’ ইত্যাদি নৃত্যনাট্য ।
পরবর্তীতে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস (পিআইএ)-এর পারফর্মিং আর্টস একাডেমিতে নৃত্য পরিচালক পদে যোগদান করেন তিনি।
তাঁর পরিচালিত নৃত্য নাট্যের মধ্যে আরো রয়েছে- নকশী কাঁথার মাঠ, ক্ষুধিত পাষাণ, সিন্ধু, কাজরী এবং আলীবাবা ৪০ চোর।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ‘বাংলাদেশ পারফর্মিং আর্টস একাডেমি’তে এবং পরে ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি’তে নৃত্য পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
গুণি নৃত্যশিক্ষক জি এ মান্নান, চলচ্চিত্রেও নৃত্য পরিচালনা করেছেন। তাঁর নৃত্য পরিচালিত ছবিগুলো হলো- আসিয়া, এদেশ তোমার আমার, রাজধানীর বুকে, যে নদী মরু পথে, হারানো দিন, মালান, নয়ন তারা, দি রেইন, লাল সবুজের পালা, জোকার, তওবা, মৌ-চোর, চাঁপা ডাঙ্গার বউ, সহযাত্রী, রাইবিনোদিনী, প্রভৃতি।
নৃত্যকলায় অনন্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার জি.এ মান্নানকে, ১৯৮২-তে একুশে পদকে ভূষিত করে।
এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সংগঠন থেকে অনেক সম্মাননা স্মারক লাভ করেন।
নৃত্যশিল্পী, নৃত্যশিক্ষক ও নৃত্য পরিচালক জি.এ মান্নান, বাংলাদেশের নৃত্য চর্চার পথিকৃৎদের অন্যতম একজন । উচ্চাঙ্গনৃত্যে, বিশেষত মণিপুরী নৃত্যে তাঁর পারদর্শিতা ছিল অসাধরন, অথচ তিনি আত্মনিয়োগ করেন লোকনৃত্য চর্চায়। নৃত্যনাট্যে তখনকার সময়ে নতুন ধারার প্রবর্তক ছিলেন তিনি। নৃত্য ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্যের, অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব জি.এ মান্নান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, বাংলাদেশের নৃত্যকলাজগতে ।