সুরকার-সঙ্গীতপরিচালক আলী আকবর রুপু’র তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০১৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৯ বছর। প্রয়াত আলী আকবর রুপু’র প্রতি শ্রদ্ধা জানাই এবং তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
আলী আকবর রুপু ১৯৫৯ সালের ৩১ আগস্ট, মুন্সীগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মনসুর আলী, বিখ্যাত বেহেলা বাদক ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। মা জামিলা মনসুর, এ দেশের প্রথম মহিলা সেতার বাদক। তাঁর চাচা প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ধীর আলী মিয়া। তাঁর দাদা ওস্তাদ শের আলী মিয়া, উপমহাদেশের প্রথম বাংগালী মুসলমান যন্ত্রশিল্পী ছিলেন। খ্যাতিমান সঙ্গীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী, তাঁর মামা। তাঁর ভাই-বোনেরা অনেকেই সঙ্গীতের সাথে যুক্ত।
সঙ্গীত পরিবারে জন্ম নেয়া আলী আকবর রুপু, গিটারিস্ট ও কিবোর্ড বাদক হিসেবে সঙ্গীতজগতে যাত্রা শুরু করেন । পরবর্তিতে সুরকার ও সঙ্গীতপরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৮০ সালে ‘একটি দুর্ঘটনা’ নামে অ্যালবাম দিয়ে অডিও গানে তাঁর অভিষেক ঘটে। প্রথম করা অডিও ক্যাসেটের গানগুলো বেশ প্রশংসিত হয়, জনপ্রিয়তা পায়।কণ্ঠশিল্পী ছিলেন আবেদ রাজ্জাক।
১৯৮২ সালের দিকে ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ড দলে কিছুদিন গিটার ও কি-বোর্ড বাজিয়েছিলেন। পরে ‘উচ্চারণ’ ছেড়ে দিয়ে ‘উইন্ডস’ নামে একটি ব্যান্ড দল গঠন করেন।
‘উইন্ডস’ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তিনটি অডিও ক্যাসেটের অ্যালবাম। ৮২/৮৩ সালের দিকে তৎকালীন দর্শকপ্রিয় নায়ক-নায়িকা জুটি জাফর ইকবাল ও অঞ্জনা’কে নিয়ে একটি অডিও ক্যাসেটের অ্যালবাম প্রকাশ করেছিলেন আলী আকবর রুপু ।
আলী আকবর রুপু গীতিকার হিসেবে অনেক গানও রচনা করেছেন। কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও তাঁর বেশ সুনাম ছিল। এক সময় তিনি গান লেখা ও গান গাওয়া কমিয়ে দিয়ে, ধীরে ধীরে সুর ও সঙ্গীত পরিচালনায় মনোনিবেশ করেন। সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেই এক সময় তিনি পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা পান। মূলত তিনি অধিক পরিচিতি পান, জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে। টানা ২৫ বছর ‘ইত্যাদি’র গানের সুর ও কম্পোজ করেছেন আলী আকবর রুপু।
তিনি, টেলিভিশন চ্যানেল ‘বাংলাভিশন’-এর শুরু থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত সঙ্গীতপরিচালক হিসেবে কাজ করে গেছেন। বেসরকারি টিভি চ্যানেল- বাংলাভিশন, এনটিভি, ইটিভি এবং এটিএন বাংলা’র উদ্বোধনী গানের সুর-সঙ্গীত তাঁর করা। চ্যানেল আই’য়ের প্রথম মেগাসিরিয়াল ‘জোয়ার ভাটা’ নাটকের অতিজনপ্রিয় টাইটেল সং-এর সুর ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি।
আলী আকবর রুপু সুরারোপিত উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে, ‘একদিন কান্নার রোল পড়বে আমার বাড়িতে’, ‘যারে ঘর দিলা সংসার দিলা রে’, ‘দস্যু যেমন মুখোশ পরে প্রবেশ করে ঘরে’, ‘দরদিয়া’, ‘এ অনিশ্চয়তা’, ‘এক পশলা বৃষ্টি’, ‘পদ্মপাতার পানি নয়’, ‘সব চাওয়া কাছে পাওয়া’, ‘কবিতার মতো মেয়েটি, গল্পের মতো ছেলেটি’ ‘প্রতিটি শিশুর মুখে হাসি’, ‘আমি আগের ঠিকানায় আছি’, ‘তোমাকে দেখলেই মৌনতা ভুলে যাই’, ‘জানতে চেয়ো না কোন সে বেদনাতে’, ‘পুরোনো কাপড়ের মতো আমি আজ অবহেলিত’, ‘বারে বারে পোড়া বাঁশি এত রাতে আর ডেকো না’, ‘এ দেশ আমার স্বপ্নে দেখা নয়, এ দেশ আমার স্মৃতির রেখা নয়’, ‘স্বাধীনতা তুমি কি কোন ঝড়ানো পলাশফুল, স্বাধীনতা তুমি কি কোন মায়ের এলানো চুল’, ‘একতারা বাজাইও না, দোতারা বাজাইও না’ (সংগীত), ‘পাগল মন, মনরে’ (সংগীত), প্রভৃতি।
আলী আকবর রুপু সুরকার ও সঙ্গীতপরিচালক হিসেবে কয়েকটি চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন। তিনি যে কয়েকটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন তাঁর- ‘রাস্তার রাজা’, ‘জাঁদরেল বউ’, ‘দড়িয়া পাড়ের দৌলতি’ ও ‘দুই বেয়াইর কীর্তি’ অন্যতম।
ব্যক্তিগতজীবনে আলী আকবর রুপু ১৯৮৫ সালে, নার্গিস আকবরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির এক ছেলে, আলী আফজাল সিডনী ও এক মেয়ে, ফারিহা নাজ আপন। তাঁর দুই ছেলে-মেয়েই সঙ্গীতের সঙ্গে জড়িত।
বাংলাদেশে ৮০/৯০ দশকের অডিও গানের জগতে সুপরিচিত নাম আলী আকবর রুপু। তখনকার সময়ে ক্যাসেটের গানের জগতে যারা অনন্য ভূমিকা রেখেছেন, বাংলাদেশের গানকে জনপ্রিয় করেছেন, দেশের আনাচে-কানাচে দেশীয় গানের সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে দিয়েছন, আলী আকবর রুপু তাদেরই একজন।
প্রায় ২৫ বছর ধরে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র অসংখ্য গানের সুর করেছেন। দর্শক-শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন বহু জনপ্রিয় সুমধুর গান।
হানিফ সংকেতের মুখে ‘ইত্যাদি’র প্রতিটি পর্বে, আলী আকবর রুপুর নাম শোনাটা, দর্শক-শ্রোতাদের কাছে হয়ে উঠেছিলো নিয়মিত বিষয়।
বাংলাদেশের সঙ্গীতজগতে আলী আকবর রুপু- চির অমলিন।
ছবি কৃতজ্ঞতা- নার্গিস আকবর