বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের বিস্ময়কর এক প্রতিভা ছিলেন তিনি। অসংখ্য চলচ্চিত্রের সুপারহিট, জনপ্রিয়, কালজয়ী গানের সুরস্রষ্টা তিনি। তিনি কিংবদন্তী সঙ্গীতজ্ঞ- সত্য সাহা। এই মানুষটির আজ ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ১৯৯৯ সালের ২৭ জানুয়ারি, ৬৫ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।
প্রয়াণ দিবস-এ সত্য সাহা’র প্রতি অন্তহীন শ্রদ্ধা এবং তাঁর আত্মার চিরকল্যাণ কামনা করি।
সত্য সাহা ১৯৩৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলাধীন নন্দীরহাট গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর বাবা জমিদার প্রশন্ন কুমার সাহা। ১৯৪৮ সালে ‘নারায়ণ রামকৃষ্ণ স্কুল’ থেকে এণ্ট্রান্স এবং ১৯৫২ সালে ভারতের ‘কলকাতা বিদ্যাসাগর কলেজ’ থেকে বি.এ পাস করেন তিনি।
স্কুলে অধ্যয়নকালেই পন্ডিত সুপর্ণা নন্দীর কাছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে তালিম গ্রহণ করেন তিনি। এ সময় ভজন গানেও কিছু পারদর্শিতা অর্জন করেন।
১৯৫৬ সালে বাংলাদেশ বেতারের সুরকার পঞ্চানন মিত্রের সহকারী হয়ে সঙ্গীতে কাজ শুরু করেন । ১৯৬১-তে তিনি বেতারে কন্ঠশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।
সত্য সাহা পঞ্চাশের দশকে ভারতের কলকাতায় ‘মেজোমশাই’ ও ‘জালিয়াত’ ছবিতে সহকারী সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন।
১৯৬১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘তোমার আমার’ ছবিতে গায়ক হিসেবে প্রথম ঢাকার চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন। সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে প্রথম কাজ শুরু করেন আলী মনসুর পরিচালিত ‘জানাজানি’ ছবিতে, কিন্তু সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁর প্রথম মুক্তি পায় সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সুতরাং’ ছবিটি (১৯৬৪)। সত্য সাহা’র সুর ও সঙ্গীতে যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয় তারমধ্যে- সুতরাং, জানাজানি, রূপবান, ১৩নং ফেকু ওস্তাগর লেন, ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো, ভাওয়াল সন্ন্যাসী, চাওয়া পাওয়া, আয়না ও অবশিষ্ট, মোমের আলো, এতটুকু আশা, বাঁশরী, সাইফুল মুলক বদিউজ্জামাল, মধুমালা, অপরিচিতা, চেনা অচেনা, মোমের আলো, আবির্ভাব (গানও গেয়েছেন), চোরাবালি, পদ্মানদীর মাঝি, নায়িকা, সূর্য উঠার আগে, নীল আকাশের নিচে, আলিঙ্গন, দীপ নেভে নাই, বিনিময়, ছদ্মবেশী, নতুন প্রভাত, সাধারণ মেয়ে, সমাধান, মানুষের মন, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, স্বীকৃতি, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, অতিথি, পরিচয়, আলোর মিছিল, ধন্যিমেয়ে, চাষীর মেয়ে, গড়মিল, আসামী, বন্ধু, মধুমিতা, দাবী, অলংকার, নয়নমনি, সূর্য কন্যা, অমর প্রেম, লাঠিয়াল, সমাধি, পালংক, সেতু, মা, রূপালি সৈকতে, আনারকলি, বসুন্ধরা, অশিক্ষিত, অগ্নিশিখা, মাটির ঘর, বদলা, শহর থেকে দূরে, অংশিদার, সোনার তরী, জিঞ্জির (গানও গেয়েছেন), স্বামী, সুখে থাকো, ছুটির ঘণ্টা, লাল সবুজের পালা, জনতা এক্সপ্রেস, লাল কাজল, পুরস্কার, মায়ের আঁচল, বাসর ঘর, মেহমান, পরাণ পাখি, ইনসাফ, গুনাই বিবি, অপেক্ষা, রঙ্গীন রূপবান, সন্ধি, বীরঙ্গনা সখিনা, শ্বশুর বাড়ী, আগুনের পরশমণি, অজান্তে, দীপু নাম্বার টু, চুড়িওয়ালা অন্যতম।
তিনি কিছু টেলিভিশন নাটকেরও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন।
সত্য সাহা সুরারোপিত জনপ্রিয় গানের মধ্যে- তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়.., এমন মজা হয় না, গায়ে সোনার গয়না.., তুমি আসবে বলে, কাছে ডাকবে বলে.., নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা.., আমার মন বলে তুমি আসবে.., সাতটি রঙ এর মাঝে আমি নীল খুঁজে না পাই.., তোমারই পরশে জীবন আমার ওগো ধন্য হলো.., জানতাম যদি শুভঙ্করের ফাঁকি.., চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা…, দুঃখ আমার বাসর রাতের পালঙ্ক.., চিঠি দিও প্রতিদিন.., বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম.., বন্ধু তোর বরাত নিয়ে আমি যাব.., এই পৃথিবীর পরে কত ফুল ফোটে আর ঝড়ে.., কোন কিতাবে লেখা আছে গো হারাম বাজনা গান.., আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল.., ঐ দূর দূরান্তে…, মাগো মা ওগো মা…, আমি যে আঁধারে বন্দিনী…, ঢাকার শহর আইসা আমার…, মাষ্টারসাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই…, আমি যেমন আছি তেমন রবো বউ হবো না রে…, আমার নায়ে পার হইতে লাগে ষোল আনা…, একদিন ছুটি হবে অনেক দূরে যাব.., হারজিৎ চিরদিন থাকবেই.., উল্লেখযোগ্য।
আধুনিক গান ও লোকসঙ্গীতেও তাঁর সুরদক্ষতা, শ্রোতাদেরকে আকৃষ্ট করে সমানভাবে। তিনি কয়েকটি ছবিতে নেপথ্যকন্ঠও দিয়েছেন।
সত্য সাহা বেশকটি ছবি প্রযোজনাও করেছেন- বিনিময়’ অশিক্ষিত, সাম্পানওয়ালা, ছুটির ঘন্টা, উজান ভাটি, পুরষ্কার, চরমপত্র, রাম রহিম জন, অন্যতম। তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম, ‘স্বরলিপি বানিচিত্র’।
তিনি ‘রাম রহিম জন’ নামে একটি ছবি পরিচালনাও করেন।
সত্য সাহা তাঁর কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি যেসব ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ সুর-সঙ্গীত পরিচালকের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন- ১৯৯৪ সালে ‘আগুনের পরশমণি’, ১৯৯৬ সালে ‘অজান্তে’, ২০০১ সালে ‘চুড়িওয়ালা’।
২০১৩ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন সত্য সাহা।
ব্যক্তিজীবনে তিনি রমলা সাহা’র সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই পুত্র সন্তান রয়েছে। বড় ছেলে সুমন সাহা এক সময় শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন । উল্লেখ্য যে, সুমন সাহা’কে নায়ক করে সত্য সাহা ১৯৮৯ সালে নির্মাণ করেন ‘রাম রহিম জন’ চলচ্চিত্রটি। তাঁর ছোট ছেলে আামাদের চলচ্চিত্রের স্বনামধন্য সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক, ইমন সাহা।
গুণী এই সুরস্রষ্টা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও অবদান রেখেছেন। তিনি ১৯৭১-এ কলকাতায় ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্রশিল্পী ও কুশলী সমিতি’তে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এই সময়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের উদ্যোগে ‘লিবারেশন ওয়ার ফিল্মস’ নামে নির্মিত হয় চারটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। স্টপ জেনোসাইড, এস্টেট ইজ বর্ণ, লিবারেশন ফাইটার্স এবং ইনোসেন্ট মিলিয়নস। বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই চারটি চলচ্চিত্রেরই সংগীত পরিচালনা করেন সত্য সাহা।
একজন মেধাবী সৃজনশীল সুরস্রষ্টা হিসেবে সত্য সাহা, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে তথা সঙ্গীতশিল্পে চির অমর হয়ে থাকবেন।
ছবি– ফিরোজ এম হাসান