উপমহাদেশের অন্যতম প্রথিতযশা সঙ্গীতশিল্পী, প্রসিদ্ধ সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক কমল দাশ গুপ্তর ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। গুণি এই সঙ্গীতজ্ঞর প্রতি বিন্ম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
কমল দাশ গুপ্ত (কামাল উদ্দিন আহমেদ) ১৯১২ সালের ২৮ জুলাই, নড়াইল জেলার বেন্দা গ্রামে, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম তারাপ্রসন্ন দাশ গুপ্ত। ১৯২৮ সালে তিনি ক্যালকাটা একাডেমী থেকে ম্যাট্রিক এবং পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বি.কম পাস করেন। মীরার ভজনে সুরের প্রয়োগ বিষয়ে গবেষণা করে তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অব মিউজিক ডিগ্রি অর্জন করেন।
নিজের বড় ভাই অধ্যাপক বিমল দাশ গুপ্তের কাছে খেয়াল গান দিয়ে সঙ্গীত চর্চা শুরু করেন তিনি। পরবর্তিতে ডি এল রায়ের পুত্র দিলীপ রায়, কৃষ্ণ চন্দ্র দে (কানা কেষ্ট) এবং ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খাঁর কাছে খেয়াল, ঠুমরী, দাদরাও গজলের তালিম গ্রহণ করেন ।
১৯৩৪ সাল থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানের সুরারোপ করতে থাকেন কমল দাশগুপ্ত । কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গানের সুর তিনি নিজেই করতেন। তবে মাঝে মাঝে তাঁর লিখা গান স্নেহধন্য কোনো কোনো সুরকারকে দিয়ে সুর করাতেন। সেক্ষেত্রে কমল দাশ গুপ্ত ছিলেন কবির প্রথম পছন্দ। কাজী নজরুল ইসলামের বহু জনপ্রিয় গানে তিনি সুর করেছেন। কথিত আছে যে, প্রায় তিনশত নজরুলগীতির সুর করেছেন তিনি ।
এই সময়ে তিনি মাস্টার কমল নামে নজরুল সঙ্গীতও গেয়েছেন। তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালী, যিনি উর্দু ভাষায় কাওয়ালি গান পরিবেশন করেন।
তাঁরা দুই ভাই কমল দাশ গুপ্ত ও সুবল দাশ গুপ্ত, রেডিওতে ‘চাঁদ-সুরুজ’ নামে কাওয়ালি গাইতেন।
মাত্র ২৩ বছর বয়সে হিজ মাস্টার্স ভয়েস গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গীত-পরিচালক ও সুরকার হিসেবে নিযুক্ত হন কমল দাশ গুপ্ত। কলাম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানিতেও কাজ করেছেন। রেকর্ডসংখ্যক গানে সুর করার জন্য ১৯৫৮ সালে এইচএমভিতে তাঁর সিলভার জুবিলী অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর সুরারোপিত গানের ডিস্কের সংখ্যা প্রায় আট হাজারের মত।
বাংলা-হিন্দি-উর্দু-গজল, ভজন, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, নাত্, হামদ্, নজরুলগীতি’সহ সঙ্গীতের সকল শাখায় অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন, কমল দাশগুপ্ত।
হে প্রিয় নবী রাসূল.., হেরেমের বন্দিনী কাঁদিয়া ডাকে, তুমি শুনিতে কি পাও..,সহ অনেক ইসলামী গান সুর করেও খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।
ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের সুরকার হিসেবে তিনি প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তুফান মেইল, শ্যামলের প্রেম, এই কি গো শেষ দান, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য, চন্দ্রশেখর, শেষ উত্তর, বধূবরণ’সহ অনেকগুলো ছায়াছবির সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন কমল দাশ গুপ্ত।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে আমেরিকান চিত্রপরিচালক মি. এলিস জনসন-এর ওয়ার প্রপাগান্ডা ছবির জন্য কমল দাশ গুপ্ত আবহ সঙ্গীত তৈরি করে দেন।
তিনি সুর দিয়েছিলেন হায়দরাবাদের নিজামের গোল্ডেন জুবলির বিশেষ সংগীতে ও ভারতীয় রণসংগীত- কদম কদম বারহায়ে যা.., গানেও।
কমল দাশ গুপ্ত বাংলা ছবির সুর ও সংগীত-পরিচালক হিসেবে চারবার ও হিন্দি ছবির জন্য একবার, মোট পাঁচবার শ্রেষ্ঠ সুর ও সংগীত পরিচালকের পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
কমল দাশ গুপ্ত সুরারোপিত কয়েকটি বিখ্যাত কালজয়ী গান- এনেছি আমার শত জনমের প্রেম…, ভালবাসা মোরে ভিখারী করেছে…, ভুলি নাই ভুলি নাই.., তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন…, মেনেছি গো হার মেনেছি…, পৃথিবী আমারে চায়…, যেথা গান থেমে যায়.., আমি স্বপ্ন দেখেছি.., একি স্বপ্ন শুধুই একি কল্পনা.., শোনো গো সোনার মেয়ে…, দু’টি পাখি দু’টি নীড়ে.., সেদিন নিশিথে বরিষণ শেষে.., কতদিন দেখিনি তোমায়.., মুক্তির মন্দির সোপানতলে.., আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়.., যাদের জীবন ভরা শুধু আঁখিজল…, শতক বরষ পরে.., জেগে আছি একা জেগে আছি কারাগারে…, ভেঙেছে হাল ছিঁড়েছে পাল…, আমি ভুলে গেছি তব পরিচয়…, আমার দেশে ফুরিয়ে গেছে ফাগুন.., ঘুমের ছায়া চাঁদের দেশে.., চরণ ফেলিও ধীরে ধীরে প্রিয়…, আমার যাবার সময় হলো.., তুমি হাতখানি যবে রাখো মোর হাতের ‘পরে’.., আমি বনফুল গো…, ইত্যাদি।
কমল দাশ গুপ্তের অসামান্য সুরযোজনা ও যথাযথ যন্ত্রানুষঙ্গের প্রয়োগে এসব গানগুলো পেয়েছিল এক ভিন্নমাত্রা। মানুষের মনের গহীনে আজও সুপ্ত হয়ে আছে এসব শ্রুতিমধুর গান-সুর।
সুর-সঙ্গীত সৃষ্টির পাশাপাশি বেশকিছু গানও রচনা করেছেন কমল দাশ গুপ্ত। তাঁর লিখা- মম যৌবন সাথী বুঝি এলো.., বিফলে যামিনী যায়.., কে আজি দিল দোলা.., এসব গান সুর করে রেকর্ডও বের করেছেন তিনি।
সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাঁর অন্যান্য অবদানের মধ্যে, অসাধারণ-অনন্য মৌলিক অবদান স্বরলিপির শর্টহ্যান্ড পদ্ধতির উদ্ভাবন এবং আ-কারমাত্রিক পদ্ধতি ও স্টাফ নোটেশন পদ্ধতির স্বরলিপি স্থাপন।
কমল দাশ গুপ্ত ১৯৫৫ সালে, বাংলাদেশের অন্যতম নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ফিরোজা বেগমকে বিয়ে করেন । তাদের তিন সন্তান- তাহসিন আহমেদ, হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদ । হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদ, জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতশিল্পী । বিয়ের চার বছর পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে কমল দাশ গুপ্তর নাম হয় কামাল উদ্দিন আহমেদ । ১৯৬৭ সালে, সপরিবারে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে তিনি জড়িত হন রেডিও ও টেলিভিশনের সঙ্গে।
তৎকালিন সময়ে রেডিও বাংলাদেশের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের প্রধান সঙ্গীত পরিচালক ও রেডিও অডিশন বোর্ডের প্রধান ছিলেন কমল দাশ গুপ্ত।
ঢাকায় নির্মিত একটি ছবিতেও কমল দাশ গুপ্ত সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। ছবির নাম ‘কেন এমন হয়’ মুক্তিপায় ১৯৭৫ সালে, পরিচালক অভিনেতা অমল বোস।
সুরের রাজ্যে কমল দাশ গুপ্ত ছিলেন রাজাধীরাজ-কিংবদন্তি। বিস্ময়কর সুরস্রষ্টা হিসেবে বাংলা গানের জগতে রীতিমতো স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত তিনি।
মেধা-নিষ্ঠা ও অসামান্য প্রতিভার গুণে, তাঁর সৃষ্ট গান, বাংলা গানের মুলুক ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছিল সর্বভারতীয় পর্যায়ে।
তাঁর সুরে এতো বৈচিত্র্যময়তা ছিলো যে, সমসাময়িক কেউই তাঁর ধারে কাছে আসতে পারেননি। এই সৃজনশীল মানুষটি খ্যাতির আড়ালে নিজেকে রেখেছেন লুকিয়ে সারাজীবন। আর সাধনা করে গেছেন সুদ্ধসংগীতের, করেছেন নতুন নতুন সুরের সৃষ্টি। শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন-মানুষের হৃদয়ভূমিতে নাড়া দেয়া, কালোত্তীর্ণ সব গানের সমাহার।
জীবনভর যিনি বৈচিত্র্যময়-হৃদয়গ্রাহী সুরের মূর্ছনায় মানুষের মন রাঙিয়েছেন, তাঁর নিজের জীবনের রঙ ফ্যাকাসে হয়েছে কখন, তা তিনি নিজেই বুঝতে পারেননি। সুখ-সুরের মূর্ছনায় রাঙাতে পারেননি নিজের জীবন । আমরা যারা তাঁর সুর-সুধায় ডুবে হৃদয়কে উদ্বেলিত করেছি, আমরাও কি পেরেছি তাঁর জীবনসুরের মূর্ছনা বুঝতে ? যে গান, যে সুর আমাদের বিমোহিত করেছে-উদ্বেলিত করেছে, তাঁর শ্রষ্টা অর্থাৎ সুরকার, সাধারণ লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে, কতটা অসহায়-অযত্নে-অবহেলায়-অসম্মানে অতিবাহিত করেছে তাঁর শেষ জীবন, আমরা রেখেছি কী তাঁর খবর? বুঝেছি কী তাঁর কদর?
সঙ্গীতের মহামণিষী কমল দাশ গুপ্ত, শারীরিকভাবে এই পৃথিবীতে বেচেঁ নেই। কিন্তু আছে তাঁর সৃষ্টি, আছে তার সুর, যা থাকবে অনন্তকাল। আর এই মোহনীয় সুরের মূর্ছনায়, এই পৃথিবীতে ভেসে বেড়াবেন, বেচেঁ থাকবেন- কমল দাশ গুপ্ত।