একুশে পদক প্রাপ্ত, দেশবরেণ্য অভিনয়শিল্পী এবং কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ লেখক ও চিত্রপরিচালক এটিএম শামসুজ্জামান (১০ সেপ্টেম্বর ১৯৪১ – ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১)-এর মৃত্যুতে, শোক-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা তাঁর প্রতি। কিংবদন্তী অভিনেতা গুণী মানুষ এটিএম শামসুজ্জামান-এর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
এটিএম শামসুজ্জামান ( আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান) ১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, নোয়াখালী জেলার দৌলতপুরে নানাবাড়িতে, জন্মগ্রহণ করেন। পৈত্রিকবাড়ি লক্ষীপুর জেলার ভোলাকোটের বড়বাড়ি, আর ঢাকায় থাকতেন দেবেন্দ্রনাথ দাস লেনের সূত্রাপুরে। তাঁর পিতা নূরুজ্জামান ছিলেন নামকরা উকিল এবং রাজনীতিবীদ । মাতা নুরুন্নেসা বেগম। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে এটিএম শামসুজ্জামান ছিলেন সবার বড়।পড়াশোনা করেছেন ঢাকার পগোজ স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল, রাজশাহীর লোকনাথ হাই স্কুলে। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট হাই স্কুল থেকে। তারপর জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। ছাত্রজীবন থেকেই লেখা-লেখির সাথে যুক্ত হন এটিএম শামসুজ্জামান। তখনকার সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা কবিতা ছাপা হতো। সে সময়ে মঞ্চেও কাজ করেছেন তিনি।
এটিএম শামসুজ্জামান চলচ্চিত্রে আসেন ১৯৬১ সালে, পরিচালক উদয়ন চৌধূরীর ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক হিসেবে। এরপর তিনি নারায়ণ ঘোষ মিতা’সহ অনেক পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন। চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়ার আশা নিয়ে, চলচ্চিত্রে আসা এটিএম শামসুজ্জামান এক সময় হয়ে যান বিখ্যাত অভিনেতা। প্রথম দিকে ছোট-খাটো চরিত্রে, নির্ধারিত শিল্পীর অনোপস্থিতিতে তাঁকে অভিনয় করতে হতো। আর এভাবেই চলচ্চিত্র পরিচালক না হয়ে, হয়ে যান দেশবরেণ্য ও জননন্দিত এক কিংবদন্তী অভিনেতা।
এটিএম শামসুজ্জামান অভিনীত চলচ্চিত্রসমূহ- এতটুকু আশা, মলুয়া, নয়া জিন্দেগি, বড় বউ, জলছবি, অবুঝ মন, ওরা ১১ জন, শ্লোগান, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, সংগ্রাম, অনন্ত প্রেম, ভুল যখন ভাঙ্গলো, চোখের জলে, বেঈমান, লাঠিয়াল, অভাগী, নয়নমনি, যাদুর বাঁশি, বন্ধু, গোলাপী এখন ট্রেনে, হারানো মানিক, অশিক্ষিত, নদেরচাঁদ, সূর্যদীঘল বাড়ী, রূপেররাণী চোরের রাজা, মাটির ঘর, সোনার চেয়ে দামি, শহর থেকে দূরে, সঙ্গীনি, অভিমান, ওয়াদা, সাম্পানওয়ালা, আসামী, আগুনের আলো, কাপুরুষ, বাজিমাৎ, নাগরদোলা, এখনই সময়, মাটির পুতুল, কথা দিলাম, শেষ উত্তর, এমিলের গোয়েন্দাবাহিনী, ছুটির ঘণ্টা, লাল কাজল, মহানায়ক, জীবন মৃত্যু, এতিম, দোস্তী, দেনাপাওনা, পুরস্কার, জনতা এক্সপ্রেস, শাহজাদা, সোনারতরী, সুখে থাকো, আপন ভাই, আল্লাহ মেহেরবান, রাজবন্দী, বদনাম, কালো গোলাপ, সিকান্দার, সীমার, বাসরঘর, চেনামুখ, মেহমান, প্রিন্সেস টিনা খান, ভালো মানুষ, প্রেমনগর, চ্যালেঞ্জ, বড় মা, অন্ধবধূ, হাসু আমার হাসু, সময় কথা বলে, বংশধর, পরিবর্তন, তালাক, বউ কথা কও, ষড়যন্ত্র, মৎসকুমারী, মনাপাগলা, মায়ের আঁচল, রামের সুমতি, ফুলেশ্বরী, ইন্সপেক্টর, শুভরাত্রি, সাথী, প্রেমিক, অস্বীকার, পাগলী, দুলারী, ইনসাফ, শিরি ফরহাদ, তালুকদার, উসিলা, চাঁপাডাঙার বউ, তওবা, ওগো বিদেশেনী, পরিনীতা, শত্রু, ফুলের মালা, প্রেমবিরহ, মর্যাদা, ঢাকা-৮৬, দায়ী কে?, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, দোলনা, ঘৃণা, অচেনা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, অজান্তে, স্বপ্নের নায়ক, ভন্ড, তোমার জন্য পাগল, ম্যাডাম ফুলি, চুড়িওয়ালা, শ্বশুরবাড়ী জিন্দাবাদ, লঙ্কাকাণ্ড, জামাই শ্বশুর, আধিয়ার, শাস্তি, মোল্লা বাড়ির বউ, হাজার বছর ধরে, আমার স্বপ্ন তুমি, দাদীমা, আয়না, ডাক্তার বাড়ী, চাঁদের মতো বউ, মন বসেনা পড়ার টেবিলে, এবাদত, পরাণ যায় জ্বলিয়ারে, কুসুম কুসুম প্রেম, গেরিলা, লালটিপ, চোরাবালি, পাগল তোর জন্য, দুটি মনের পাগলামি, দুই বেয়াইয়ের কীর্তি, আইসক্রিম, পাংকু জামাই, রাত্রির যাত্রী, আলফা, ইত্যাদি।
এটিএম শামসুজ্জামান শুধু চলচ্চিত্রেই না, অভিনয় করেছেন মঞ্চ-বেতার ও টেলিভিশনেও। অভিনয় জীবনের প্রথম থেকে ষাটের দশকেই টিভিনাটকে অভিনয় শুরু করেন তিনি। স্বাধীনতার আগে যে ‘সংশপ্তক’ নাটক টিভিতে প্রচারিত হয়েছে, সেখানে এটিএম শামসুজ্জামান ‘রমজান’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তিনি বিটিভির বহু বিখ্যাত বিখ্যাত সব নাটকে অভিনয় করেছেন। পরবর্তিতে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল-এ অসংখ্য নাটকে, নানাধরণের চরিত্রে তিনি অভিনয় করেগেছেন।
এটিএম শামসুজ্জামান প্রায় শতাধিক চলচ্চিত্রের কাহিনী-চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছন। তিনি
প্রথম কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখেছেন ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রের জন্য। এইচ আকবর পরিচালিত এই ছবিটি মুক্তিপায় ১৯৭১ সালে। এ ছবির মাধ্যমেই নায়ক ফারুক-এর চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়। তিনি আরো যেসব চলচ্চিত্রের কাহিনী-চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছন- জীবন তৃষ্ণা, সীমার, ওরা ১১ জন, দায়ী কে?, মোল্লা বাড়ির বউ, ডাক্তার বাড়ী, এবাদত, তারমধ্যে অন্যতম।
এটিএম শামসুজ্জামান একটি চলচ্চিত্র পরিচালনাও করেছিলেন। নিজের প্রযোজনায়, শাবনূর-রিয়াজকে নিয়ে ‘এবাদত’ নামের এই ছবিটি ২০০৯ সালে নির্মাণ করেন।
এটিএম শামসুজ্জামান তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। যারমধ্যে উল্লেখযোগ্য- জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ‘দায়ী কে?’ (১৯৮৭), শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা ‘ম্যাডাম ফুলি’ (১৯৯৯), শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা ‘চুড়িওয়ালা’ (২০০১), শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’ (২০০৯), পার্শ্বচরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ‘চোরাবালি’ (২০১২), আজীবন সম্মাননা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (২০১৭), শিল্পকলায় বিশেষ অবদেনর জন্য ‘একুশে পদক’ ( ২০১৫), ঢাকা মডেল এজেন্সি এ্যাওয়ার্ড আজীবন সম্মাননা (২০১৯), বুলবুল আহমেদ স্মৃতি সম্মাননা পদক (২০১৯)’সহ আরো পেয়েছেন বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক নানা পুরস্কার ও সম্মাননা।
এটিএম শামসুজ্জামান বাংলাদেশের একজন অতিজনপ্রিয় ও নিবেদিত প্রাণ অভিনয়শিল্পী ছিলেন। সিনেমা ও নাটক উভয় ক্ষেত্রেই তিনি সুঅভিনয়ে, প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। নিজেকে নিয়ে গেছেন, জনপ্রিয়তার সু-উচ্চ শিখড়ে। বাংলাদেশের একজন কিংবদন্তি অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।
খলনায়ক-হরর-কমেডি যে চরিত্রই করেছেন, সব চরিত্রকেই তিনি ভিন্নমাত্রায়, ভিন্ন আঙ্গিকে রূপায়ন করেছেন তাঁর বহুমাত্রিক অভিনয় প্রতিভার গুণে। তাঁর রক্তের শিড়ায়-উপশিড়ায় মিশে ছিলো শুধুই অভিনয়। পেয়েছেন তুমূল জনপ্রিয়তাও। জননন্দিত, সৃজনশীল সুঅভিনেতা, হিসেবে মহিরুহো ব্যক্তিত্ব ছিলেন এটিএম শামসুজ্জামান।
চলচ্চিত্রের তথা শিল্প-সংস্কৃতির সাথে সংশ্লিষ্টরা যতবেশী এটিএম শামসুজ্জামান-এর মতো কৃতিমানদের অনুসরণ করবেন, ততবেশী সমৃদ্ধ হবে আমাদের চলচ্চিত্র তথা শিল্প-সংস্কৃতির জগত।
আমাদের পারফর্মিং মিডিয়ার অত্যান্ত বর্ণাঢ্য সফল ব্যক্তিত্ব, দেশবরেণ্য কিংবদন্তী অভিনয়শিল্পী এটিএম শামসুজ্জামান-এর চলে যাওয়া, আমাদের চলচ্চিত্র, অভিনয়শিল্প তথা শিল্প-সংস্কৃতির, অপূরণীয় ক্ষতি।