এ কে আজাদ: শামসুদ্দিন টগর। চলচ্চিত্র পরিচালক-অভিনেতা। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের একজন সফল নির্মাতা তিনি। তাঁর পরিচালিত প্রায় প্রতিটি ছবিই ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় হয়েছে। এক সময়ের সুপারহিট চলচ্চিত্র পরিচালক ছিলেন তিনি। তাঁর চলচ্চিত্রকর্ম পরিধি সফলতায় ও জনপ্রিয়তায় পরিপূর্ণ। এক সময় তাঁর জনপ্রিয়তাও ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু চলনে-বলনে ছিলেন, অতি সাধারণ এক শান্তিপ্রিয় মানুষ। তিনি একজন ভালো অভিনেতাও বটে। অনেক চলচ্চিত্রে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা শামসুদ্দিন টগর এর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০১২ সালের ২৩ জুলাই, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। প্রয়াত চিত্রপরিচালক শামসুদ্দিন টগর-এর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
শামসুদ্দিন টগর ১৯৪৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর, খুলনা জেলার ডুমরিয়া থানার টুরনা গ্রামে, জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মিয়া মতিন ছিলেন পুলিশ অফিসার, মা নাসুদা খাতুন। তের ভাই-বোনের মধ্যে শামসুদ্দিন টগর ছিলেন সবার বড়। তাঁর ছোট দুই ভাইও অভিনয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন। এক ভাই মহিউদ্দিন লালু অভিনয় করতেন মঞ্চে, আরেক ভাই টেলিভিশনের বিখ্যাত অভিনেতা, কামালউদ্দিন নিলু। এফডিসি’র কর্মকর্তা ও চিত্রপরিচালক প্রয়াত আবদুল মতিন সাহেব ছিলেন তাঁর শ্বশুর।
বাবার বদলির চাকরির সুবাদে শামসুদ্দিন টগর বিভিন্ন জেলায়, বিভিন্ন স্কুলে পড়া-লেখা করেছেন। তিনি ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে মেট্রিক ও ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। কলেজে থাকা অবস্থায়ই ফরিদপুরের বিভিন্ন মঞ্চে নাটক করে বেড়াতেন তিনি, ‘মিনার্ভা’ নামে তাদের একটি নাট্যগ্রুপ ছিল।
চলচ্চিত্রে আসার আগে পিডিবি’তে চাকুরী করতেন শামসুদ্দিন টগর। অভিনয় পাগল সাংস্কৃতিমনা শামসুদ্দিন টগর, তৎকালীন সময়ে ভালোমানের সরকারি চাকরি ছেড়ে, নিজের ভালোবাসার জায়গা চলচ্চিত্রে মনোনিবেশ করেন ।
১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘কার বউ’ ছবির সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত হন তিনি। চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্তের সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন ।
শামসুদ্দিন টগর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র পারভেজ ফিল্মস-এর ব্যানারে, সোহেল রানা প্রযোজিত ‘দস্যু বনহুর’ মুক্তিপায় ১৯৭৬ সালে। তিনি ‘সারথী’ ছদ্মনামে এই ছবিটি পরিচালনা করেন। তাঁর পরিচালিত অন্যান্য ছবিগুলো হলো- বানজারান, মহেশখালীর বাঁকে, আখেরী নিশান, হুর-এ আরব, গলি থেকে রাজপথ, দখল, সম্রাট, রাজ ভিখারী, নকল শাহজাদা, নূরী, মহুয়া সুন্দরী, হুমকী, রতনমালা, সতী কমলা, যুবরাজ, জজ সাহেব, চেনাজানা শত্রু, ইত্যাদি।
শামসুদ্দিন টগর, চিত্রপরিচালকের পাশাপাশি একজন ভালো অভিনেতাও ছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি কিছু চলচ্চিত্রে খলনায়ক-সহনায়ক হিসেবে বিভিন্ন ছবিতে অভিনয় করেছেন। শেষের দিকে তিনি নিয়মিত চলচ্চিত্র এবং নাটকে অভিনয় করেই ব্যস্ত ছিলেন । তাঁর অভিনীত ছবি- সংগ্রাম, হারজিৎ, দস্যু বনহুর, এপার ওপার, গোপন কথা, দম মারো দম, মাসুদ রানা, জীবন নৌকা, জজ সাহেব, স্বপ্নের বাসর, স্বপ্ন পূরণ, জীবনের চেয়ে দামী, মেঘের কোলে রোদ, বিন্দুর ছেলে, ভালোবাসার লাল গোলাপ, হুমকীর মুখে, সুন্দরী বধূ, মা-বাবার স্বপ্ন, ভালোবাসার শেষ নাই, তুই যদি আমার হইতি, সমাজের শত্রু, মায়ের জন্য মরতে পারি, প্রভৃতি।
ব্যক্তিজীবনে শামসুদ্দিন টগর ১৯৭১ সালে, একসময়ের নাট্যশিল্পী রেবা শামসুদ্দিনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তান রয়েছে। মেয়ে বেথুন শামসুদ্দিন, জামাতা মিনা মাসুদ উজ্জামান (উপ-সচিব) । দুই ছেলে নাসিরউদ্দিন কমল ( Singer & Station Manager of Radio spice ) ও জালালউদ্দিন মিথুন ( Assistant Manager, Kollol group)।
শামসুদ্দিন টগর পরিচালিত প্রায় প্রতিটি ছবিই ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় ছিল। অনেক হিট-সুপারহিট ছবির নির্মাতা তিনি। এক সময়ের সুপারহিট চলচ্চিত্র পরিচালক ছিলেন তিনি।
তাঁর জনপ্রিয়তাও ছিল আকাশচুম্বী। তবুও তিনি দেখতে ছিলেন, অতি সাধারণ। তাঁকে দেখে বা তাঁর সাথে কথা বলে বুঝাই যেত না, যে তিনি- দস্যু বনহুর, বানজারান, মহেশখালীর বাঁকে, আখেরী নিশান, হুর-এ আরব, গলি থেকে রাজপথ, দখল, সম্রাট, রাজ ভিখারী, নকল শাহজাদা, হুমকী’র মতো হিট-সুপারহিট ছবির পরিচালক!
এতো সাদা-সিধে, সাধারণ এক ভদ্র-ভালো মানুষ ছিলেন, শামসুদ্দিন টগর। তাঁর চলচ্চিত্রকর্ম পরিধি সফলতায় ও জনপ্রিয়তায় পরিপূর্ণ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে তাঁর অবদান অবশ্য অবশ্যই স্মরণযোগ্য।