বাংলা গানের সুরের যাদুকর আলাউদ্দিন আলী’র প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০২০ সালের ৯ আগস্ট, মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। দেশবরেণ্য এই সঙ্গীতজ্ঞর প্রতি বিন্ম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
গীতিকার-সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী ১৯৫২ সালের ২৪ ডিসেম্বর, মুন্সীগঞ্জের টংগিবাড়ী থানার বাঁশবাড়ী গ্রামে, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জাবেদ আলী ও মাতার নাম জোহরা খাতুন।পুরানো ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড এবং মতিঝিলের এজিবি কলোনীতে কাটে তাঁর শৈশব।
আলাউদ্দিন আলী তাঁর পিতা ওস্তাদ জাবেদ আলী ও ছোট চাচা সাদেক আলীর কাছে প্রথমে সঙ্গীতে শিক্ষা নেন। ছোটবেলাতেই খুব ভালো ‘বেহালা’ বাজাতেন তিনি । ‘অল পাকিস্তান চিলড্রেনস বেহালাবাদক’ প্রতিযোগিতায় তিনি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। তৎকালীন রেডিওতে শিশুদের অনুষ্ঠানে ‘বেহালা’ বাজাতেন।
তিনি যন্ত্রশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্র জগতে আসেন এবং সঙ্গীতজ্ঞ আলতাফ মাহমুদের সহকারী হিসেবে কাজ করে। পরে তিনি আরো কাজ করেন, প্রখ্যাত সুরকার আনোয়ার পারভেজসহ বিভিন্ন সুরকারের সাথে। ‘বেহুলা’ ও ‘কত যে মিনতি’সহ অনেক ছবিতেই আলাউদ্দিন আলী বেহালা বাজিয়েছেন।
১৯৭২ সালে দেশাত্মবোধক গান- ও আমার বাংলা মা তোর…, গানের মাধ্যমে সুর ও সংগীত পরিচালক হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।
আলাউদ্দিন আলীর সঙ্গীত পরিচালনায় প্রথম ছবি ‘সন্ধিক্ষণ’ মুক্তিপায় ১৯৭৬ সালে। তাঁর সুর ও সঙ্গীত পরিচালনায় অন্যান্য ছবিগুলোর মধ্যে- গোলাপী এখন ট্রেনে, ফকির মজনু শাহ, সুন্দরী, সূর্যদীঘল বাড়ি, কসাই, জন্ম থেকে জ্বলছি, দুই পয়সার আলতা, নতুন পৃথিবী, প্রেমনগর, বানজারান, নাগরদোলা, মান অভিমান, বড় বাড়ির মেয়ে, নাজমা, নসীব, পরিবর্তন, সখিনার যুদ্ধ, শক্তি, ভাতদে, প্রেমিক, নালিশ, ইন্সপেক্টর, মাসুম, ঈদ মোবারক, যোগাযোগ, ভাই বন্ধু, স্বামী-স্ত্রী, মালা বদল, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, স্বাক্ষী, স্বর্পরাণী, ঢাকা-৮৬, সৎভাই, পদ্মা নদীর মাঝি, চরম আঘাত, লাখে একটা, আদরের সন্তান, সাগরিকা, আত্মত্যাগ, স্বপ্নের পৃথিবী, গোলাপী এখন ঢাকায়, দেনমোহর, অঞ্জলি, সত্যের মৃত্যু নেই, শেষ খেলা, বেঈমানী, বাঁচার লড়াই, অচল পয়সা, বাবা কেন চাকর, লাল দরিয়া, সুন্দরী বধূ, স্বপ্নের বাসর, কাল সকালে, পিতার আসন, প্রভৃতি।
আলাউদ্দিন আলীর সুরারোপিত উল্লেখযোগ্য কালজয়ী জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে- একবার যদি কেউ ভালোবাসতো…, যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়…, প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ…, ভালোবাসা যতো বড়ো জীবন তত বড় নয়…, দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়.., হয় যদি বদনাম হোক আরো…, আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার…, সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারও ঘরণী…, আমি আছি থাকবো…, চোখের নজর এমনি কইরা…, সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি ও আমার বাংলাদেশ…, বন্ধু তিন দিন তোর বাড়ি গেলাম দেখা পাইলাম না.., যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে, মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে…, এমনও তো প্রেম হয়, চোখের জলে কথা কয়…, সবাই বলে বয়স বাড়ে, আমি বলি কমে রে…, আমায় গেঁথে দাওনা মাগো, একটা পলাশ ফুলের মালা…, শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে…, কেউ কোনো দিন আমারে তো কথা দিল না…, পারি না ভুলে যেতে, স্মৃতিরা মালা গেঁথে…, জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো…, আমার মনের ভেতর অনেক জ্বালা আগুন হইয়া জ্বলে…, হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ…, ইস্টিশনের রেলগাড়িটা, মাইপা চলে ঘড়ির কাঁটা.., কারো আপন হইতে পারলি না অন্তর.., তুমি আরেকবার আসিয়া যাও মোরে কান্দাইয়া.., বাবা বলে গেলো আর কোনোদিন গান করো না…, যেভাবে বাঁচি বেঁচে তো আছি, জীবন আর মরণের কাছাকাছি…, খোদার ঘরে নালিশ করতে দিলো না আমারে.., আজ বড় সুখে দুটি চোখে জল এসে যায়…, আমি ভালোবাসার সুখে মরে যেতে চাই…, এ জীবন তোমাকে দিলাম ও বন্ধু, তুমি শুধু ভালোবাসা দিও.., আমরা তো বানজারান দেখাব নাচ গান.., তুমি আমার মনের মানুষ মনেরই ভিতর.., এ সুখের নেই কোনো সীমানা.., তোমাকে চাই আমি আরো কাছে.., বাড়ির মানুষ কয় আমায় ভুতে ধরেছে.., কিছু কিছু মানুষের জীবনে ভালোবাসা চাওয়াটাই ভুল.., পাথরের পৃথিবীতে কাঁচেরই ঘর.., এতো ভালোবেস না আমায়.., এমন মিষ্টি একটা বউ…, চিঠি এলো জেলখানাতে অনেক দিনের পর.., ভেঙ্গেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা.., ইত্যাদি।
সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তিনি সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন। এরমধ্যে- গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮), সুন্দরী (১৯৭৯), কসাই (১৯৮০), ছবিতে পরপর তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে, পুরস্কৃত হয়েছেন। এছাড়াও তিনি গীতিকার হিসেবে ‘প্রেমিক’ ছবিতে ১৯৮৫ সালে, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি বেতার ও টেলিভিশনের জন্যও অসংখ্য গানে সুর করেছেন আলাউদ্দিন আলী। সেসব গানও পেয়েছে জনপ্রিয়তা। ‘একতারা মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশন’ নামে তিনি একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। যেখানে থেকে সংগীত তৈরির নানান কাজ করা হয়। তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছেন।
আলাউদ্দিন আলী একাধারে যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও প্রযোজক । পারিবারিক সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা আলাউদ্দিন আলী, সুরের সাধনায় লিপ্ত থেকেছেন সবসময়। তিনি যন্ত্রসংগীতের প্রতি গভীর সাধনা করেছেন, দীর্ঘমেয়াদি অনুশীলন করেছেন। সুরের সাধনায় নিমগ্ন থেকেছেন। তাঁর অব্যাহত সাধনায় সুরের ইন্দ্রজালের যাদুকর হয়েছেন একসময়।
লোকজ ও ধ্রুপদী গানের সংমিশ্রণে তিনি গড়ে তুলেছিলেন, সুরের ভূবনে তাঁর এক নিজস্ব ধারা। শ্রুতিমধুর সুরের মূর্ছনায়, বাংলা সংগীতকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। জনপ্রিয়তার পাশাপাশি তিনি পেয়েছেন, শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের মর্যাদা। বর্ণাঢ্য সংগীত ক্যারিয়ারে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গানকে করেছেন বর্ণিলময়। জনপ্রিয়-কালজয়ীসব গানে, সমৃদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র।
অসংখ্য কালজয়ী জনপ্রিয় গানের কিংবদন্তী সুরকার। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গানের বিস্ময়কর সুরশ্রষ্টা। বাংলা গানের অসম্ভব জনপ্রিয় সুরকার, বাংলা গানের সুরের যাদুকর তিনি। বাংলাদেশের সঙ্গীতের মহিরূহ ব্যক্তিত্ব আলাউদ্দিন আলী, শারীরিকভাবে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু বেঁচে আছে তাঁর সৃষ্টি, আছে তাঁর শ্রুতিমধুর সুর করা হাজারো গান, যা থাকবে অনন্তকাল। তাঁর এই গানের মোহনীয় সুরের মূর্ছনার মধ্যদিয়ে অনাদিকাল বেচেঁ থাকবেন- সুরসম্রাট আলাউদ্দিন আলী।