বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা নায়ক, নায়করাজ রাজ্জাক-এর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। প্রয়াত নায়করাজ-এর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
রাজ্জাক (আবদুর রাজ্জাক) ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জে, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আকবর হোসেন। মায়ের নাম নিসারুননেছা। তিনি কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে পড়া-লেখা করেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালিন সময়ে, সরস্বতী পূজায় শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা মঞ্চ নাটক বিদ্রোহীতে অভিনয় করেন। এভাবেই রাজ্জাকের অভিনয়ের সাথে সম্পৃক্ততা হয়। তখন থেকেই তাঁর অভিনয়ের প্রতি প্রচন্ড ভালো লাগা-ভালোবাসা জন্মায়।
কলেজে পড়ার সময়ে ‘রতনলাল বাঙ্গালী’ নামে একটি চলচ্চিত্রের জন্য ক্যামেরার সামনে প্রথম অভিনয় করেন– তবে ছবিটি বহু পরে ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় ‘আমি রতন’ নামে। ১৯৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল, পরিবার নিয়ে কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন রাজ্জাক । তখন তাঁর সাথে ছিল, স্ত্রী লক্ষ্মী ও পুত্র বাপ্পারাজ। তাঁর অভিনয়ের গুরু পীযূষ বসুর দেয়া একটি চিঠি নিয়ে তিনি, পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের সাথে দেখা করেন ঢাকার কমলাপুরে। আব্দুল জব্বার খানই তাঁকে ইকবাল ফিল্মস-এ কাজ করার সুযোগ করে দেন। ১৯৬৪ সালেই রাজ্জাক সহকারী পরিচালক হিসেবে ‘উজালা’ চলচ্চিত্রে কামাল আহমেদের সাথে কাজ করা শুরু করেন।
সহকারী পরিচালক হিসেবে তাঁর দ্বিতীয় ছবি ছিল ‘পরওয়ানা’। সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার পাশাপশি- আখেরী স্টেশন, ১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন, কার বউ, ডাক বাবু এসব চলচ্চিত্রে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এর মাঝে রাজ্জাক টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামের একটি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে বেশ পরিচিতি পান।
নায়ক হিসেবে রাজ্জাকের প্রথম ছবি ‘বেহুলা’। জহির রায়হান পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালে। প্রথম কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে ফেলেন রাজ্জাক। শুরু হয় যায় বাংলাদেশে নায়করাজ রাজ্জাক ইতিহাস।
নায়করাজ রাজ্জাক অভিনীত চলচ্চিত্রসমূহ-
আগুন নিয়ে খেলা, আনোয়ারা, জুলেখা, নিশি হলো ভোর, দুই ভাই, আবির্ভাব, এতটুকু আশা, সখিনা, সুয়োরাণী দুয়োরাণী, বাঁশরী, কুচবরন কন্যা, গোরি, মনের মতো বউ, ময়না মতি, আগন্তুক, নীল আকাশের নিচে, শেষ পর্যন্ত, মেহেরবান, যে আগুনে পুড়ি, ক খ গ ঘ ঙ, আঁকা বাঁকা, জীবন থেকে নেয়া, পীচঢালা পথ, সমাপ্তি, যোগ বিয়োগ, দর্পচুর্ণ, মধুমিলন, ঢেউয়ের পর ঢেউ, টাকা আনা পাই, কাঁচ কাটা হীরে, দ্বীপ নেভে নাই, ছদ্মবেশী, অধিকার, কত যে মিনতি, পিতা পুত্র, বড় বউ, পায়েল, নাচের পুতুল, জীবন থেকে নেয়া, স্বরলিপি, স্মৃতিটুকু থাক, গাঁয়ের বধূ, মনের মতো মন, অশ্রু দিয়ে লেখা, এরাও মানুষ, ওরা ১১ জন, ছন্দ হারিয়ে গেল, অবুঝ মন, মানুষের মন, কমলরাণীর দীঘি, প্রতিশোধ, শপথ নিলাম, চৌধুরী বাড়ি, জীবন সঙ্গী, রংবাজ, ঝড়ের পাখি, পলাতক, প্রিয়তমা, যাহা বলিব সত্যি বলিব, এখানে আকাশ নীল, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, কে তুমি, অনির্বাণ, আমার জন্মভূমি, স্লোগান, অতিথি, জীবন তৃষ্ণা, খেলাঘর, আলোর মিছিল, ভুল যখন ভাঙল, বেঈমান, দুই পর্ব, পরিচয়, অবাক পৃথিবী, মাসুদ রানা, ভাইবোন, চোখের জলে, বাঁদী থেকে বেগম, সাধু শয়তান, আলো তুমি আলেয়া, আপনজন, ডাক পিয়ন, উপহার, আঁধার পেরিয়ে, অনেক প্রেম অনেক জ্বালা, কি যে করি, গুন্ডা, মায়ার বাঁধন, প্রতিনিধি, সমাধি, আকাঙক্ষা, স্মাগলার, শাপমুক্তি, সেতু, অনুরোধ, আগুন, অমর প্রেম, অনন্ত প্রেম, মতি মহল, যাদুর বাঁশি, অশিক্ষিত, সোহাগ, অঙ্গার, অগ্নিশিখা, আসামী, কাপুরুষ, বাজিমাৎ, অলংকার, জিঞ্জির, অনুরাগ, আয়না, মাটির ঘর, নাগ নাগিনী, ঘর সংসার, সোনার চেয়ে দামী, বদলা, অভিমান, রাজবন্দী, সোনার হরিণ, জোকার, ছুটির ঘণ্টা, আনারকলি, সখী তুমি কার, গাঁয়ের ছেলে, সংঘর্ষ, বৌ রাণী, নাগিন, ডানপিটে ছেলে, মহানগর, অংশীদার, দুই পয়সার আলতা, বড় ভাল লোক ছিল, রজনীগন্ধা, রাজা সাহেব, আশার আলো, নাজমা, লালু ভুলু, লাইলি মজনু, বদনাম, কালো গোলাপ, ঝুমুর, গাদ্দার, চন্দ্রনাথ, অভিযান, নতুন পৃথিবী, তালাক, বউ কথা কও, মায়ের আঁচল, গৃহলক্ষ্মী, সোনা বৌ, অসাধারণ, চোর, সৎ ভাই, ন্যায় বিচার, কাবিন, সোনালী আকাশ, শুভদা, ঢাকা- ৮৬, আওয়ারা, অভাগী, ফুলশয্যা, তওবা, দ্বীন দুনিয়া, রাজলক্ষী ও শ্রীকান্ত, স্বামী-স্ত্রী, সমর্পণ, সন্ধি, সন্ধান, জামানা, যোগাযোগ, আগমন, নীতিবান, কুসুমপুরের কদম আলী, অর্পণ, আশ্রয়, অগ্নিকন্যা, স্বাক্ষর, রাম রহিম জন, বিধাতা, দুর্নাম, বিরহ ব্যথা, রাজা মিস্ত্রি, সহধর্মিণী, শর্ত, দেবর ভাবী, প্রায়শ্চিত্ত, স্বাধীন, মালামতি, সম্মান, আদরের বোন, স্বপ্ন, অন্ধ বিশ্বাস, দরবারে-এ-খাজা, প্রফেসর, সমর, শ্রদ্ধা, জন্মদাতা, জনি ওস্তাদ, মিস্টার মাওলা, জনম দুখী, সতীনের সংসার, সবার উপরে মা, বাজিগর, জজসাহেব, বাবা কেন চাকর, উত্তর ফাল্গুনী, হৃদয়ের আয়না, পৃথিবী তোমার আমার, শেষ প্রতিক্ষা, শান্ত কেন মাস্তান, হৃদয়ে লেখা নাম, রাগী, বাবা কেন আসামী, জীবন চাবি, জানের জান, কঠিন বাস্তব, মরণ নিয়ে খেলা, বাপ বেটির যুদ্ধ, ঈমানদার মাস্তান, লাল দরিয়া, সমাজকে বদলে দাও, মেজর সাহেব, অশান্ত আগুন, স্বামী-স্ত্রীর যুদ্ধ, আঘাত পাল্টা আঘাত, মায়ের জেহাদ, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, টপ সম্রাট, বাদশা কেন চাকর, বাপ বেটার লড়াই, আমাদের সন্তান, পিতার আসন, কোটি টাকার কাবিন, এই যে দুনিয়া, আমি বাঁচতে চাই, জীবনের চেয়ে দামী, মা বাবার স্বপ্ন, ১ টাকার বউ, পিতামাতার আমানত, আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা, জমিদারবাড়ির মেয়ে, মিয়াবাড়ির চাকর, ভালোবাসার শেষ নেই, পীরিতীর আগুন জ্বলে দ্বিগুণ, তুমি আমার স্বামী, কাজের মানুষ, মন দিয়েছি তোমাকে, সবাই তো ভালোবাসা চায়, চাচ্চু আমার চাচ্চু, পাঁচ টাকার প্রেম, বাপ বড় না শ্বশুর বড়, রিকশাওয়ালার ছেলে, হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ, ভালোবাসার রঙ, মোস্ট ওয়েলকাম, অন্যরকম ভালোবাসা, আয়না কাহিনী, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, এক কাপ চা, আকাশ কত দূরে, কার্তুজ, ইইত্যাদি।
চলচ্চিত্র পরিচালক-প্রযোজক হিসেবেও নায়ক রাজ্জাক পেয়েছেন সফলতা, রেখেছেন তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর। তাঁর প্রযোজিত ও পরিচালিত ছবি- আকাঙক্ষা, অনন্ত প্রেম, পাগলা রাজা, বেঈমান, জোকার, বদনাম, অভিযান, সৎ ভাই, চাঁপাডাঙ্গার বউ, মৌ চোর, ঢাকা-৮৬, জ্বীনের বাদশা, প্রফেসর, রাজা মিস্ত্রী, মালামতি, বাবা কেন চাকর, উত্তর ফাল্গুনী, প্রেমশক্তি, মরণ নিয়ে খেলা, সন্তান যখন শত্রু, প্রেমের নাম বেদনা, আমি বাঁচতে চাই, কোটি টাকার ফকির, মন দিয়েছি তোমাকে, আয়না কাহিনী, প্রভৃতি।
নায়করাজ রাজ্জাক তাঁর বর্ণাঢ্য অভিনয়জীবনে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী শ্রেষ্ঠ অভিনেতা- ছবি ‘কি যে করি’ (১৯৭৬), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা- ছবি ‘অশিক্ষিত’ (১৯৭৮), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা- ছবি ‘বড় ভালো লোক ছিল'( ১৯৮২), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা-ছবি চন্দ্রনাথ (১৯৮৪), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা- ছবি ‘যোগাযোগ’ (১৯৮৮), চলচ্চিত্রে সামগ্রিক অবদানের জন্য আজীবন সম্মাননা-২০১৩।
রাস্ট্রীয়ভাবে পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার-২০১৫।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ‘চ্যানেল আই চলচ্চিত্র মেলা-২০০৯’, পুরো রাজ্জাক পরিবারকে সম্মাননা প্রদান করে। অভিনেতা রাজ্জাকের বিশেষ অর্জন জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করা। এছাড়াও তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
ব্যক্তিজীবনে নায়করাজ রাজ্জাক ১৯৬২ সালে, খায়রুন নেসা লক্ষ্মী’র সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের পাঁচ সন্তান। নায়ক বাপ্পারাজ (রেজাউল করিম), নাসরিন পাশা শম্পা, রওশন হোসাইন বাপ্পি, আফরিন আলম ময়না ও নায়ক সম্রাট (খালিদ হোসাইন)। নায়করাজ রাজ্জাক একজন প্রতিভাবান সৃজনশীল মেধাবী অভিনেতা। রোমান্টিক প্রেমিক থেকে শুরু করে, গুন্ডা, আসামী, রংবাজ, দারোয়ান, দপ্তরী, চোর, বড় ভাই, শিক্ষক, প্রফেসর, জজ সাহেব, পুলিশ অফিসার, মৌয়াল, কৃষক, মাঝি, অন্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, রাজা-বাদশা, ডাকাত, ড্রাইভার, ডাক্তার, মাতাল, পাগল, ক্যাবারে ড্যান্সার, ডাকপিওন, জুয়াড়ি, বাবা, দাদা’সহ বিভিন্ন ধরণের চরিত্রে তাঁকে নিয়ে নির্মাতারা নানা ধরণের এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছেন এবং সফলও হয়েছেন।
নায়করাজ রাজ্জাক বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের ভিন্ন ভিন্ন ডায়ম্যানশনে হাজির হয়েছেন সিনেমাদর্শকদের সামনে। যখন যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন মানিয়ে গেছেন-উৎড়ে গেছেন বেশ ভালোভাবেই।
তাঁর সময়ের প্রায় সব নায়িকার সাথেই জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন এবং সফল হয়েছেন। তবে রাজ্জাক-কবরী জুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় সেসময়ে। এই জুটি চিরস্বরণীয় হয়ে আছে এখনো।
অসংখ্য হিট-সুপারহিট ছবির নায়ক, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা, যিনি পেয়েছেন নায়করাজ-এর খেতাব । পেয়েছেন অর্থ, যশ, খ্যাতি, সম্মান, দর্শকদের অকৃত্রিম ভালোবাসা। চলচ্চিত্রের প্রতিটি মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন আজীবন।
আমাদের দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে বাণিজ্যিকভাবে সুদৃঢ় ভিতের উপর দাঁড় করাতে নায়করাজ রাজ্জাক বিশেষ অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশের সিনেমার যথার্থ আধুনিক চিত্রনায়ক হিসেবে জয় করে নিয়েছেন কোটি মানুষের ভালোবাসা। যে ভালোবাসা মৃত্যুতে শেষ হয় না। যে ভালোবাসার মৃত্যু হয় না। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নায়ককুলের রাজা, নায়করাজ রাজ্জাক কোটি মানুষের ভালোবাসায় চিরঞ্জীব।